বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ দূষণের ফলে বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তাতে হুমকিতে পড়েছে সামুদ্রিক প্রাণী। কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলে একের পর এক ডলফিন, তিমি,শুশুকসহ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী জলজ প্রাণীর মৃত দেহ ভেসে উঠছে। প্রাণী দুটোর অবাধ বিচরণ বাংলার নদীগুলোতে দেখা গেলেও কালের বিবর্তে আজ বিলুপ্তির পথে।
গত ৩৩ মাসে মিলেছে ৬৭টি মৃত ডলফিন ও তিমি। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশ থেকে তিমি ও ডলফিন বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এসব প্রাণীর মরদেহ সৈকত থেকে উদ্ধার হওয়ায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে সচেতন মহলে। এ অবস্থায় আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রাণী দিবস। আজ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে।
ডলফিন রক্ষা কমিটির টিমলিডার রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, গত দুই মাসেই ১৬টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট ২২টি মৃত ডলফিন কুয়াকাটার ১৮ কিলোমিটার সৈকতের বিভিন্ন স্থানে ভেসে এসেছে। এগুলোকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। দিন দিন সামুদ্রিক ডলফিনের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সামুদ্রিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। ডলফিনের মৃত্যুর সঠিক কারণ খুঁজে বের করে জীববৈচিত্র্য রক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটতে পারে এমনটাই দাবি করেছেন তিনি।
নিউইয়র্কভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৬৭টি ডলফিন ও তিমি মারা গেছে। এর মধ্য ৬১টি ডলফিন ও ছয়টি তিমি। চট্টগ্রাম বিভাগে ৪০টি, বরিশাল বিভাগে ১২টি, খুলনায় ১০টি, ঢাকায় তিনটি এবং ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে একটি করে ডলফিন ও তিমি মারা গেছে। এগুলোর ৮৩ শতাংশ জালে আটকা পড়ে এবং ১৭ শতাংশ ট্রলার ও জাহাজের সঙ্গে আঘাত লেগে মারা গেছে। জালের মধ্যে ৭৮ শতাংশই মারা গেছে ফাঁস জালে আটকা পড়ে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৬৭টি ডলফিন ও তিমি মারা গেছে। এর মধ্য ৬১টি ডলফিন ও ছয়টি তিমি।
কক্সবাজার উপকূলে জীববৈচিত্র্য নিয়ে তৎপর পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশে’র হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের আগস্ট— এই এক বছরে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ টেকনাফ, উখিয়া, মাতারবাড়ী, কুতুবদিয়া উপজেলা ও সেন্টমার্টিনের সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন অংশ থেকে মোট ২৫টি ডলফিনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলোর বেশির ভাগের গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
তিমি মারা যাওয়ার কারণ
গবেষকরা বলেছেন, প্রধানত পাঁচটি কারণে বেশির ভাগ তিমি মারা যায়। তিমির মৃত্যুর প্রধান পাঁচ কারণের অন্যতম হলো, স্বাভাবিক মৃত্যু। বঙ্গোপসাগরে যেসব তিমির বিচরণ, সেগুলো ৪০ বছরের বেশি সময় বেঁচে থাকে। এরপর তারা স্বাভাবিকভাবে মারা যায়। অবশ্য সর্বশেষ যে তিমি দুটির মরদেহ ভেসে এসেছে, সেগুলোর বয়স নিরূপণ করা যায়নি। কাজেই বলা যাচ্ছে না, এগুলো বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছে কি না।
ফাঁস জালে জড়িয়েও অনেক তিমির মৃত্যু হয়। তিমির মৃত্যুর তৃতীয় আরেকটি কারণ হলো, বড় কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মৃত্যু।
চতুর্থত, প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে মৃত্যু। তিমি বিশাল হাঁ করে তার মুখ ভর্তি করে পানি নেয়। এরপর ছাঁকনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি বের করে দিয়ে মুখে প্রবেশ করা অণুজীব ও মাছ, চিংড়িজাতীয় প্রাণী গিলে খায়। ফলে সমুদ্রে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য অনেক সময় তিমির পেটে চলে যায়। এগুলো পাকস্থলীতে জমে খাদ্যের হজমপ্রক্রিয়া ব্যাহত করে। এতে তিমি ধীরে ধীরে মারা যায়।
তিমির মৃত্যুর পঞ্চম আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো রাসায়নিকের প্রভাব। খাবার বা অন্য কোনোভাবে তিমির শরীরে রাসায়নিক দ্রব্য ঢুকলে বিষক্রিয়ায় এই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
এ ছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্শা দিয়ে, পেনথ্রাইট গ্রেনেড মেরে ও গুলি করে তিমি হত্যার প্রচলন রয়েছে। অবশ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় এ ধরনের ঘটনার কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমীন বলেন, হঠাৎ তিমির মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার কারণ গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান করা উচিত। আর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলে এখন বেশ কিছু তিমি আছে। সেগুলোকে রক্ষা করতে হলে কী করতে হবে, তার বিষদ অনুসন্ধান ও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
ডলফিন মারা যাওয়ার যেসব কারণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনকে এটা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জেলেরা ওইসব এলাকায় ডলফিনের জন্য ক্ষতিকর এমন মাছ ধরার সরঞ্জাম ব্যবহার না করে। দেখা যায়, জেলেরা সাগরে জাল ফেলে তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করে জাল তোলে। অনেক সময় বোঝার কোনো উপায় থাকে না, জালে কিছু আটকে আছে কিনা। জাল তুললে দেখা যায়, ডলফিন জালে আটকে মরে আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ডলফিন জালে আটকে গিয়ে ১০ থেকে ২০ মিনিট শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারলে মারা যায়। আমরা মনে করি, সমুদ্রে ডলফিনসহ সব ধরনের জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী সুরক্ষায় জেলেদের করণীয় সর্বাধিক। একদিকে জেলেদের সচেতনতা জরুরি,একই সঙ্গে বন ও মৎস্য বিভাগের দায়িত্বও কম নয়। ডলফিন সুরক্ষায় তাদের তদারকি বাড়াতে হবে। আইনে ডলফিন শিকার ও বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এসব প্রাণী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলেন, সমুদ্রের পাশাপাশি নদীতে বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকায়ও ডলফিন হুমকির মুখে। যদিও সুন্দরবনের ডলফিন বাঁচাতে ইতোমধ্যে বন বিভাগের বিশেষ প্রকল্পে সুফল এসেছে বলে প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়। তারপরও স্বস্তিতে থাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এমনকি চট্টগ্রামের হালদা নদীতেও ডলফিন হত্যার খবর আসে প্রতি বছর।
নদীতে দূষণ, মাত্রাতিরিক্ত শিকার, পাচার, আবাসস্থল বিনষ্ট, মাত্রাতিরিক্ত যান চলাচল ও বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরার কারণে ডলফিন হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু সমুদ্রে জাল দিয়ে মাছ ধরার পাশাপাশি জেলেরা পলিথিন বা ছেঁড়া জাল ফেলে দেওয়ায় তাতে আটকেও জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটতে পারে। তাই এখনই জেলেদের সচেতন করে সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষার পাশাপাশি সমুদ্রের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্দিষ্ট এলাকায় সৈকতে স্থায়ীভাবে জাল পাতা বন্ধ ও অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। সংশ্নিষ্ট এলাকায় নিয়মিত টহলের জন্য বন বিভাগের নৌযান ও জনবল বাড়ানোর পাশাপশি স্থানীয়দেরও ডলফিন সুরক্ষায় সচেতন করা দরকার। যে কোনো উপায়ে এসব জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে জীববৈচিত্র্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে এবং বিপন্ন হবে প্রতিবেশ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৩
আপনার মতামত জানানঃ