পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পরপরই রাজ্য বিজেপিতে ভাঙনের ঢেউ লাগে। রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল দলটি, কিন্তু ২০০ আসন জেতা তো দূর, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কার্যত পর্যুদস্ত হয়েছে বিজেপি। আর তারপর থেকেই বিজেপি ছাড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই ৫ মাসে ৫ বিধায়ক দল ছেড়েছেন। বিধানসভা ভোটের পর থেকে মুকুল রায়সহ চার বিজেপি বিধায়ক ইতিমধ্যেই নাম লিখিয়েছেন শাসক দল তৃণমূলে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে যেভাবে বিজেপিতে যোগদান বেড়েছিলো, এখন দেখা যাচ্ছে তারই উল্টোচিত্র। এখন বিজেপি ছেড়ে বাড়ছে তৃণমূলে ফেরার স্রোত। খবর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম
সাধারণত কোন নির্বাচনের আগেই নামি-দামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে যোগ দিতে দেখা যায়, কিংবা এক দল ছেড়ে আরেক দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক প্রতিটি নির্বাচনেও এ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত মার্চ-এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায় প্রতিদিনই পালা করে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-কাউন্সিলর-পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাও দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। দলবদলের হিড়িক দেখে অনেকেই মুচকি হেসে কটাক্ষ করেছিলেন যে তৃণমূল দল আদৌ থাকবে কি না!
গত ২ মে ভোটের ফল বের হয়, তাতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। এরপর সরকারও গড়ে তারা। কিন্তু ভোটপর্ব মিটলেও ফের দলবদলের হিড়িক! তবে এবার ছবিটা উল্টো! বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক পড়েছে কলকাতা থেকে জেলায় জেলায়।
ভারতের কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির লক্ষ্য ছিল বিধানসভার নির্বাচনে ২০০ আসন পার করে ক্ষমতায় আসবে। আসন সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে ওই নির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয়, লকেট চ্যাটার্জি, স্বপন দাশগুপ্ত, জগন্নাথ সরকার, নিশীথ প্রামানিকসহ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে দাঁড় করিয়ে চমক দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু ক্ষমতায় আসা তো দূরের কথা, মাত্র ৭৭ আসনে জয় পেয়েই তাদের বিজয় রথ থমকে যায়।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসা হয়নি, এরই মধ্যে একের পর এক ধাক্কা বিজেপিতে। আগেই দল ছেড়েছেন মুকুল রায়সহ চার বিধায়ক। তারা ছাড়াও রীতিমতো চমকে দিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। শুক্রবার ফের ধাক্কা বিজেপি-তে৷ এবার দল ছাড়লেন রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী৷ তিনি এখনও তৃণমূলে যোগ না দিলেও রায়গঞ্জের সাংসদ দেবশ্রী চোধুরীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বিজেপি ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছেন রায়গঞ্জের বিধায়ক। এই পরিস্থিতিতে দলে ফের ভাঙন অব্যাহত থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। কৃষ্ণ কল্যাণীর দল ছাড়া ও দেবশ্রী চৌধুরীর সঙ্গে তার সংঘাতের প্রসঙ্গেও সেই চিন্তার কথাই বলেছেন রাজ্য বিজেপির নতুন সেনাপতি।
শুক্রবার কৃষ্ণ কল্যাণীর দলত্যাগ প্রসঙ্গে সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘রায়গঞ্জে আমাদের সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী আর দল ছেড়েছেন ওই এলাকার বিধায়ক। একজন বিধায়ক আর একজন সাংসদের মধ্যে এই মতবিরোধ, এই ধরনের কথাবার্তা তো চিন্তার বিষয়ই।’ তবে, তার বিরুদ্ধে যে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন সুকান্ত। প্রসঙ্গত, এদিন দল ছাড়ার সময় দেবশ্রী চৌধুরীকে মীরজাফর বলে আক্রমণ করেছেন কৃষ্ণ কল্যাণী। পাল্টা দেবশ্রীর অভিযোগ, নিজের স্বার্থেই দল ছেড়েছেন বিধায়ক। তৃণমূলে যাওয়ার জন্য এখন অজুহাত খুঁজছেন।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসা হয়নি, এরই মধ্যে একের পর এক ধাক্কা বিজেপিতে। আগেই দল ছেড়েছেন মুকুল রায়সহ চার বিধায়ক। তারা ছাড়াও রীতিমতো চমকে দিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। শুক্রবার ফের ধাক্কা বিজেপি-তে৷ এবার দল ছাড়লেন রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী৷
যদিও দল বিরোধী কাজের অভিযোগে ইতিমধ্যেই রায়গঞ্জের বিধায়ককে শোকজ করেছে বিজেপি শৃঙখলারক্ষা কমিটি। বিধায়ক পদ থেকে কৃষ্ণ কল্যাণীর ইস্তফা দাবি করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। বিধায়কের অবশ্য অভিযোগ, রায়গঞ্জের সাংসদ তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন। যদিও দেবশ্রীর দাবি, এই বিধায়ক দল ছাড়লেও বিজেপি-র কোনও ক্ষতি হবে না। বরং এটা প্রত্যাশিতই ছিল। বিজেপি ছেড়ে কৃষ্ণ কল্যাণী এবার তৃণমূলে যোগ দেবেন কি না, সেই বিষয়টি তিনি এখনও খোলাসা করেননি৷ অবশ্য বিধায়ক ঘনিষ্ঠরা সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন৷
তবে, একের পর এক বিধায়কের দল ছাড়ায় চিন্তায় পড়েছেন বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। এদিন সুকান্ত মজুমদারকে অভ্যর্থনা দিয়েছে রাজ্য বিজেপি। সেই অনুষ্ঠানে অবশ্য প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ উপস্থিত ছিলেন না। আর সেখানেই দলে ভাঙন প্রসঙ্গে সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘আমরা বিধায়কদের সঙ্গে কথা বলছি। ব্যক্তিগত স্বার্থের থেকে দলীয় স্বার্থ আমাদের কাছে অনেক বড়। আমরা নীতি-আদর্শ মেনে দল করি। তাই সকলকেই অনুরোধ করছি, দলীয় স্বার্থের কথা ভেবে আসুন একসঙ্গে কাজ করি।’ আর রাজ্য সভাপতির সেই ‘অনুরোধ’ নিয়েই জল্পনা বাড়ছে রাজ্য বিজেপিতে। তাহলে কি আরও ভাঙনের আশঙ্কা করছে গেরুয়া শিবির?
প্রসঙ্গত, রাজ্য সভাপতি হওয়ার পর প্রথম দিল্লি সফরে গিয়েও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফেও বিশেষ বার্তা পেয়েছেন সুকান্ত। দলে ভাঙন আটকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সুকান্ত বাবুকে, বিজেপি সূত্রে এমনটাই খবর। দিন কয়েক আগেই রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘কয়েকদিন বাদে এমন একটা নাম আসবে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে, চিন্তা করতে পারবেন না।’ কিন্তু কে সেই নেতা, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি মন্ত্রী।
ফিরহাদের সেই মন্তব্যের প্রেক্ষিতেও সুকান্ত মজুমদার বলেছিলেন, ‘যারা নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে দল করেন, তারা কেউ বিজেপি ছেড়ে যাবেন না। সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত আছি। কিন্তু, যাদের সমস্যা হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব, কোনও রাগ-ক্ষোভ থাকলে আসুন, আলোচনা করুন দলের মধ্যেই। আমি মনে করি, আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমরা একসাথে লড়াই করব সবাই। আর সেই লড়াইয়ের প্রেক্ষিতেই এই সরকারকে উৎখাত করা শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
এদিকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, খেলা তো সবে শুরু হল৷ আগামীতে আরও অনেক বড় চমক অপেক্ষা করছে।’ বিজেপিতে যেভাবে ভাঙন বাড়ছে, তাতে চমক নিয়ে বেজায় জল্পনা পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতিতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৬
আপনার মতামত জানানঃ