ক্ষমতায় আসার সময় মহিলাদের নিয়ে নিজেদের মনোভাব স্পষ্ট করেছিল তালিবান। বারবার জানিয়েছিল, আগের বারের মতো মহিলা বিদ্বেষের পুনরাবৃত্তি হবে না এ বার। তার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাবুল দখলের মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তানে নিজেদের মুঠি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছে তালিবান। কিন্তু নয়া জমানায় যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন নিজেদের পুরনো কট্টর অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে আখুন্দজাদা-বরাদরের তালিবান।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আফগানদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্যই নারী অধিকারের ফাঁকা বুলির উপর নির্ভর করেছিল তালিবান। সময়ের সাথে খোলস ছেড়ে নিজেদের অবস্থানেই ফিরে আসছে এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেল টোলো নিউজে একটি আলোচনাচক্রে হাজির হয়ে তালিবান মুখপাত্র বলেন, মহিলাদের কী কী করণীয়। সেই সূত্রেই আরও একবার প্রকাশ্যে এল নারীদের নিয়ে তালিবানের মনোভাব।
সেখানে কোনও রাখঢাক না রেখেই তালিবান মুখপাত্র জানিয়ে দিলেন মহিলাদের জন্য তিন শর্ত। প্রথমত, মহিলাদের পোশাক যেন আকর্ষণীয় না হয়। দ্বিতীয়ত, তাদের শরীর থেকে যেন সুগন্ধ না বার হয়। অর্থাৎ, বাড়ি থেকে বেরনোর সময় তারা যেন সুগন্ধী ব্যবহার না করেন। তৃতীয়ত, মহিলাদের ‘লং বুট’ পড়া নিষিদ্ধ। কারণ বুটের টক-টক আওয়াজে পুরুষের মনে খারাপ চিন্তার উদয় হয়।
শুধু ফতোয়া জারিতেই অবশ্য তালিবান মুখপাত্র থামেননি। বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছেন মহিলারা বুট পড়লে, ঠিক কোন উপায়ে পুরুষের মনে খারাপ চিন্তা ভাবনার উদয় হয়।
টোলো নিউজে তালিবান মুখপাত্রকে বলতে শোনা যায়, ‘‘মহিলারা বুট পরে যখন হেঁটে যান তার আওয়াজ শুনেছেন? টক-টক আওয়াজের অর্থ কী? ওই আওয়াজ আসলে আহ্বান। মহিলারা ওই আওয়াজ করে ঘুমন্ত পুরুষকে বলে, ‘আমরা সেজেগুজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি, আর তোমরা এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছো! তাহলে আমাদের দেখবে কে?’ আসলে পুরুষদের ঘুম থেকে তুলে মনে খারাপ চিন্তা আনার জন্যই ওই বুটগুলো তৈরি করা হয়।’’
তাই মহিলাদের জন্য বুট নিষিদ্ধ। এ দিকে ১৫ অগস্ট কাবুল দখলের পর থেকেই আফগানিস্তানে রাতারাতি বেড়ে গিয়েছিল বোরখা, হিজাব, পাগড়ির চাহিদা। তার পর থেকে একের পর এক ফতোয়া জারি করে চলেছে তালিবান। সব মিলিয়ে সময় বদলালেও তালিবানের কোনও বদল নেই। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন আফগান বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, চিত্রশিল্পীদের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও ফরমান জারি করেনি তালিবান নেতৃত্ব। কিন্তু কুড়ি বছর আগের সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনও তাড়া করে বেড়ায় আফগান চিত্রশিল্পীদের। তালিবান যোদ্ধারা কাবুলের দোরগোড়ায় পৌঁছনোর আগেই তাই নিজেদের আঁকা কমপক্ষে ১৫টি আধুনিক ছবি মাটির তলায় পুঁতে দিয়েছেন বেশ কয়েক জন আফগান শিল্পী।
সব ক’টি ছবিরই বিষয়বস্তু ছিল আফগান নারীদের আধুনিক রূপ। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে সম্প্রতি এ খবর জানানো হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েক জন আফগান শিল্পী এই খবরের সত্যতাও স্বীকার করে নিয়েছেন। শুধু ছবিই নয়, আফগান শিল্পীরা নষ্ট করে দিচ্ছেন নিজেদের অনেক ভাস্কর্যও।
একটি প্রথম সারির আমেরিকান দৈনিক আবার জানাচ্ছে, এক আফগান মহিলা চিত্র পরিচালক দেশ ছেড়ে পালানোর আগে কুড়িটিরও বেশি ফিল্ম পেন ড্রাইভে একটি গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন। নতুন তালিবানি শাসনে বিদেশি বইও বিক্রি করতে ভয় পাচ্ছেন দোকানদারেরা। তালিবানি অত্যাচারের ভয়ে স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করা বাইবেল লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন কাবুলের বিক্রেতারা। তারা পরিষ্কার জানাচ্ছেন, এই সব বই বিক্রি হচ্ছে জানতে পারলে তাদের মেরে ফেলতে পারে তালিবান।
গত কুড়ি বছর ধরে পাশ্চাত্য শাসনে অভ্যস্ত আফগান শিল্প ও সংস্কৃতি আচমকা থমকে গিয়েছে তালিবানি অত্যাচারের ভয়ে। কাবুলের সব ক’টি আর্ট গ্যালারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আফগান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও বন্ধ। বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলি ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে ভয়ে। বিয়ে বাড়িতে ব্যান্ড বাজানোও বন্ধ এখন।
এদিকে, আফগানিস্তানের মানুষ এই পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে পালাতে গেলেও তালিবান তাদের হুমকি দিয়ে বলছে, ‘এই দেশ তোমাদের, তোমরা এখান থেকে পালাতে পারবে না’। স্পিন বোলদাক এলাকায় পাক সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে গত কয়েক দিন ধরে আশ্রয় নিয়েছেন জাকারিউল্লা। জানালেন, দেশে কোনও কাজ নেই। পরিবারের মুখে খাবার জোগাতে পারছেন না। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে কাজের খোঁজে যেতে চান। কিন্তু এখানেও তাদের রাস্তা আটাকাচ্ছেন তালিবান।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৩২
আপনার মতামত জানানঃ