‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ধারণাটি তুলে ধরে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেই প্রথম প্রচারে নামে আওয়ামী লীগ। এরপর ক্ষমতায় এসে তাদের সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগের কথা জানান দেয়। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘গ্রাম হবে শহর’ স্লোগানকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার পল্লী উন্নয়নকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছে। সে সময় বিভিন্ন মহল থেকে এই উদ্যোগের সমালোচনা করে বলা হয়, গ্রামের উন্নয়ন দরকার, কিন্তু গ্রামকে শহর করার চিন্তা নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিন্তু সরকার তার পরিকল্পনা থেকে পিছু হঠেনি। ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া হয়েছে এই প্রকল্পের আয়োজন। একটু গুছিয়ে নিয়ে এখন আবার নতুন করে গ্রামকে শহর বানানোর উদ্যোগকে প্রচারের আলোয় আনতে চায় আওয়ামী লীগ। দলটির নীতি নির্ধারকরা বলছেন, মামনীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে এই প্রকল্প। আমরা এবার দৃঢ় পদক্ষেপে এগোতে চাই, বলেছেন দলটির কেন্দ্রীয় একজন নেতা।
সরকারপক্ষ বলছে, ‘সব বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখেই গ্রাম হবে শহর।’ এ লক্ষ্যে দেশের ৮৭ হাজার ২৩০টি গ্রামে শহরের সব সুবিধা পৌঁছানোর বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এজন্য ‘আমার গ্রাম আমার শহর : নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা’ একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩১ কোটি টাকা।
তবে সরকারের এই উদ্যোগের পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে নানা মত। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বিরোধীরা বলছে, গ্রামকে শহর বানানো যাবে না। গ্রামগুলো বরং আরও আদর্শ গ্রাম হবে, আরও বেশি আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে খাদ্য দিয়ে ছায়া দিয়ে মানুষকে রক্ষা করবে। গ্রামীণ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভিত্তি বজায় রেখে তার সহায়ক পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটাতে হবে এবং তা স্থানীয় জনগণ ও জনবান্ধব বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সম্পাদন করতে হবে।
প্রবাসী সংবাদকর্মী মাহাবুব হায়দার লিখেছেন, ‘এরা গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্য বুঝে না। গ্রামকে ধ্বংস করে শহর বানানোকে এরা উন্নয়ন মনে করে। অথচ উন্নত বিশ্ব পুরানোকে ধরে রাখার জন্য কি পরিমাণ বিনিয়োগ করে ভাবাই যায় না। গ্রামকে আধুনিক গ্রাম করতে পারে, শহর নয়। পশ্চিমা বিশ্ব শহরকে আধুনিক গ্রাম বানানোর জন্য কত ধরনের চেষ্টাই না করছে।’
কাজী তৌহিদ লিখেছেন, ‘দেশতো অনেক আগেই সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়া হয়ে গেছে। এবার গ্রামকে শহরে রূপান্তরের পালা।’ আবার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের চেহারা তুলে ধরতে গিয়ে নূরে আলম সিদ্দিকি লিখেছেন, ‘এরা ভোটের রাজনীতিতে যে শহর বানাতে চায় সেটা আসলে শহর নয়। আমাদের থানা প্রপারে ৫২৮ টা লাইট পোস্ট লাগিয়েছে সৌরবিদ্যুত চালিত। এটাই নাকি নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত শহর!’
মানুষের চিন্তায় উদ্বেগও প্রকাশ পেয়েছে এ বিষয়ে। দুলাল সরকার লিখেছেন, ‘গ্রামের জমি কোটিপতি, দখলদার, দুর্নীতিবাজরা কিনে নিলে শহর হতে আর সময় লাগবে না।’ কুমকুম সিকদার লিখেছেন, ‘আমাদের ট্যাক্সের টাকার শ্রাদ্ধ হবে, এখন গ্রামকে শহর বানানোর জন্য টাকা ঢালবে। তারপর কিছুদিন পর আসবে নতুন প্রকল্প। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো সেরকম একবার ঠিক করে আবার ভাঙে, সেরকম আবার শুরু হবে শহরকে গ্রাম বানানোর উদ্যোগ। ফুটবলের মতো খেলছে।’
জনমতের ছাপ মেলে বিশেষজ্ঞ মতামতেও। সমাজ সংগঠক, পরিবেশবিদ, অর্থনীতিবিদদের মতে, শহরে মানুষ বাড়ছে বটে, তবে এটা ভুল নীতির ফল। এ কারণেই শহরগুলো বিশ্বের বিষফোঁড়ার মতো হয়ে গেছে। বায়ু দূষণে তো মানুষ অতিষ্ঠ। বড় শহরগুলো বড় দূষণের আখড়া। প্রচণ্ড গরম, গাছপালা কম, যানজট, এই হলো শহর। উন্নত বিশ্বের কিছু শহর দেখলে সাজানো পরিপাটি মনে হতে পারে, তবে সেসব শহরকে ওভাবে রাখতে যে পরিমাণ পরিবেশের ক্ষতি করতে হয় তা অকল্পনীয়। বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার, সবই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে এবং প্রাণীকূলের বিপদ ডেকে আনছে। এ অবস্থায় গ্রামগুলোকে আদর্শ রূপ দেয়া এবং শহরগুলোর মধ্যে গ্রামকে টেনে আনার চিন্তাই একমার বিকল্প। সেখানে আমাদের দেশের সরকার বলছে, গ্রামকে শহর বানানর কথা। এটা পশ্চাৎপদ, গণবিরোধী ও বিপর্যয়কর ভাবনা। অচিরেই এই প্রকল্প বন্ধ হওয়া উচিত। আমাদের দর্শনগত অবস্থান হওয়া উচিত শহর হলো কারখানা, গ্রাম হলো লোকালয়। কারখানাআগুলোকে লোকালয়ের মতো করে বানাতে হবে। নীতিগতভাবে এর অন্যথা হলে আমরা বিপর্যয়ই বাড়িয়ে তুলব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটা আওয়ামী লীগের সেকেলে মানসিকতা ও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফল। দলটির নেতারা প্রায়শই দেশ সিঙ্গাপুর, লস এঞ্জেলেস হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন। এটা দেখিয়ে দেয় যে, তারা নিজ দেশের তথা এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য মাথায় না রেখেই চিন্তা করেন। সরকারি দলের একজন সাংসদ, যিনি ঢাকা ১৬ আসনের প্রতিনিধি, ইলিয়াস মোল্লা, একবার আফ্রিকা ভ্রমণ থেকে ফিরে আফ্রিকার কঙ্গোর কালো মানুষগুলো এখনো সভ্যতা পায়নি বলে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের সভ্য করার জন্য গিয়েছে।’ এসব উদাহরণ দেখায় যে, আওয়ামী লীগ নেতারা উন্নতি বুঝতে পশ্চিমাদের উন্নয়ন আর উন্নত বলতে সাদাদের বোঝে। এটা মারাত্মক ভ্রান্তি এবং আমাদের জনগণের বিকাশের পরিপন্থী।
তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, উন্নয়নের বিরোধিতা করার জন্যই এসব বলা হচ্ছে। তারা পিছু টেনে ধরতে চায়। গ্রামকে উন্নত করাই বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ। মামনীয় প্রধানমন্ত্রী এবার সেই চ্যালেঞ্জও জয় করবেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সর্বশক্তি দিয়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করবে। নেতাদের এমন বক্তব্যের প্রতিফলন মেলে দলটির প্রচার প্রচারণা থেকে। বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে তারা।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা হবে ৩০টি গাইডলাইন, ৫১টি সমীক্ষা প্রতিবেদন ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)। এছাড়া দেশের ৮৭ হাজার ২৩০টি গ্রাম উন্নয়নের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্কও করা হবে। ২৫ নভেম্বর ২০২০, বুধবার প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রক্রিয়াকরণ শেষে অনুমোদন পেলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) কাজ বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এছাড়া ৩৬টি সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে। সেই সঙ্গে ১৫টি পাইলট গ্রামের আলাদা সমীক্ষা করা হবে। এসবের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জগুলো এবং উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন করা হবে। এছাড়া দেশের ৮টি বিভাগের সমতলের ৮টি গ্রাম এবং ডেল্টা প্ল্যানের হট স্পট ও অর্থনৈতিক অঞ্চল সংলগ্ন ১৫টি গ্রামে পাইলট গ্রাম নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করা করে প্রকল্প তৈরি করা হবে।
ইতোমধ্যেই নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। যেটি প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পটি হাতে নেয়া হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটি চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দহীনভাবে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই। তবে এটি প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি নেয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় আমার গ্রাম আমার শহরের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া তৈরি হতে যাওয়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও এ বিষয়ের প্রতিফলন রয়েছে। কেননা এটি সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তাই এর বাস্তব রূপায়নের বিষয়টি পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত আছে।
মিই/আরা/১০২০
আপনার মতামত জানানঃ