পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদরোগ। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দেশে কম বয়সী মানুষের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ তরুণের মধ্যে একজন হৃদরোগ ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমনকি দেশে সর্বোচ্চ মৃত্যুও ঘটছে হৃদরোগে।
বাংলাদেশ স্টেপস সার্ভের সর্বশেষ মৃত্যুসংক্রান্ত তথ্য অনুসারে দেশে মোট মৃত্যুর ৭৩ শতাংশ ঘটছে অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। আগে পঞ্চাশের কম বয়সীদের মধ্যে হৃদরোগের তেমন ঝুঁকি ছিল না, এখন ৪০-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম কম করা, ধূমপানের প্রবণতা ও হতাশা-দুশ্চিন্তার প্রভাব বেশি বলে জানানো হয়েছে। এক গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি পাঁচ জন তরুণের মধ্যে একজন হৃদরোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে, আগের চেয়ে ৫০ বছরের নিচে বিশেষ করে ৪০-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে হৃদরোগের প্রকোপ বেড়েছে। এ জন্য তাদের মধ্যে সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে হবে। ধূমপান বা তামাক ব্যবহার বন্ধে তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন করে সুষম খাদ্য গ্রহণ, প্রতিদিন হাঁটাহাঁটি করা, ওজন, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর জোর দিতে হবে।
বিশ্ব জুড়ে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস করতে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাদ্য গ্রহণ হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই দ্রুত ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করা না গেলে হৃদরোগ ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়তেই থাকবে।
সূত্র মতে, ট্রান্সফ্যাট একটি ক্ষতিকর খাদ্য উপাদান, যা হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ডালডা বা বনস্পতি ঘি এবং তা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার, ফাস্টফুড ও বেকারি পণ্যে ট্রান্সফ্যাট থাকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ খসড়া প্রণয়ন করেছে। প্রয়োজনীয় ভেটিং শেষে এটি চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
‘গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই)-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করতে না পারলে দেশে ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগ ঝুঁকি বাড়বে, চিকিৎসা খাতে ব্যয় বাড়বে এবং আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, ‘তরুণরা ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার বেশি খেয়ে থাকে। খাদ্যদ্রব্য থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করা না গেলে তরুণ প্রজন্ম মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে।’
ট্রান্সফ্যাট কী এবং কীভাবে ক্ষতি করে?
বেশির ভাগ ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয় শিল্পপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিজ্জ তেল তৈরির সময় তাতে হাইড্রোজেন যুক্ত হয়। এই আংশিক হাইড্রোজেনযুক্ত উদ্ভিজ্জ তেল, যা স্বাভাবিক কম তাপমাত্রায় শক্ত হয়ে যায়, সেটিই হলো ট্রান্সফ্যাট। এটি খুব বেশি ক্ষতিকর না হলেও খাবার তৈরির সময় উদ্ভিজ্জ তেল পরিবর্তন না করে ভাজার জন্য বারবার ব্যবহার করলে তা বেশি বেশি ট্রান্সফ্যাটে পরিণত হয়, যা শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর।
নানা রকম বেকারিপণ্য যেমন: কেক, কুকিজ ট্রান্সফ্যাট–সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে অন্যতম। প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন রকমের খাবার, ফ্রোজেন খাবার এবং নানা ভাজাপোড়া খাবার, ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও ট্রান্সফ্যাটের অন্যতম উৎস।
রক্তে যেসব কোলেস্টেরল থাকে, সেগুলোর মধ্যে দুই ধরনের কোলেস্টেরল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কম ঘনত্বের কোলেস্টেরলের বা এলডিএল, যা ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল হিসেবে গণ্য। এ ধরনের কোলেস্টেরল হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির দেয়ালে চর্বি জমাট বাঁধতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং রক্তনালিগুলো সরু হয়ে রক্ত চলাচলে বাধাগ্রস্ত করে। তাতে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
উচ্চ ঘনত্বের কোলেস্টেরলের বা এইচডিএল, যা ‘ভালো’ কোলেস্টেরল। এই কোলেস্টেরল রক্তের ‘খারাপ’ কোলেস্টেরলকে রক্ত থেকে যকৃতে বয়ে নিয়ে যায় এবং রক্তনালির দেওয়ালে চর্বি জমতে দেয় না।
ট্রান্সফ্যাট আপনার রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয় এবং ‘ভালো কোলেস্টেরল কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। এভাবে ট্রান্সফ্যাট রক্তের স্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রায় অস্বাস্থ্যকর প্রভাব ফেলে এবং ট্রান্সফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার হার্ট অ্যাটাক, মস্তিষ্কের স্ট্রোক, রক্তনালির অসুখ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ