কাবুলের মসনদে বসেই হাজার হাজার খুনি-অপরাধীদের জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিল তালিবান। তার পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আফগানিস্তানের মহিলা বিচারপতিরা।
‘ইউরোউইকলি’-র রিপোর্ট বলছে, তালিবান ক্ষমতায় আসার পর এখনও পর্যন্ত আফগানিস্তানে ২২০ জনের বেশি মহিলা বিচারপতি ঘরছাড়া। এই বিচারপতিদের অধিকাংশই মহিলাদের অধিকার নিয়ে সরব ছিলেন। প্রাণের ভয়ে এখন তারা গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন জাজেস (আইএডব্লিউজে)-এর ছোট ছোট গোষ্ঠী করে কিছু আফগান মহিলা বিচারক দেশ থেকে পালাতে পেরেছেন। তবে, অধিকাংশই মহিলা বিচারকই রয়ে গিয়েছেন আফগানিস্তানে। তারা এখনও তালিবানদের দখল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তালিবানদের বন্দিমুক্তি সারা দেশে আফগান মহিলা বিচারকদের জীবনকে বিপদে ফেলেছে। প্রত্যেক বিচারকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালাচ্ছে এই মুক্তি প্রাপ্ত অপরাধীরা।
সম্প্রতি, আরও ৪-৫জন মহিলা বিচারকের সঙ্গেই ইউরোপের কোনও এক অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে এসেছেন, আফগানিস্তানের পদচ্যূত সরকারের এক উচ্চপদস্থ মহিলা বিচারক। পালিয়ে এসেও নিজের নাম ও আশ্রয়স্থলের নাম বলতে সাহস করেননি তিনি। তবে জানিয়েছেন, নিরাপদ জায়গায় আসার পর দেশে ফোন করে তিনি জানতে পেরেছেন তার খোঁজে এসেছিল তালিবান বন্দিরা।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাবুলে, তার বাড়িতে হানা দিয়েছিল চার-পাঁচজন তালিবান সদস্য, যাদের একসময় তিনি কারাগারে বন্দি করেছিলেন। তারা এসে ওই মহিলা বিচারকের সন্ধান করেছিল।
তার সহকর্মীরাও তাকে যেসব খবরাখবর দিয়েছেন, তা শুধুই ভয়ের এবং সন্ত্রাসের। আফগানিস্মতান থেকে অন্যান্য মহিলা বিচারকরা সাফ জানিয়েছেন, তাদের কেউ উদ্ধার না করলে প্রাণ রক্ষাই তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ মুক্তিপ্রাপ্ত তালিবান বন্দিরা মহিলা বিচারক, মহিলা সরকারি আইনজীবী এবং মহিলা পুলিশ কর্মকর্তাদের খোলাখুলি হত্যার হুমকি দিয়েছে। এর আগে বারবারই আইন বিভাগে কর্মরত হাই প্রোফাইল আফগান মহিলারা তালিবানদের নিশানা হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আফগানিস্তানের এক প্রাক্তন বিচারপতি ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, খুন, অত্যাচার, ধর্ষণে অভিযুক্ত অনেককেই সাজা দিয়েছিলেন তিনি। তারা এখন জেল থেকে বেরিয়ে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎই এক মধ্যরাতে জানতে পারি, বন্দিদের মুক্তি দিচ্ছে তালিবান। খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়ি ছেড়ে আমরা পালাতে হয়েছে আমাদের। বোরখা পরে শহর ছাড়তে হয়েছে। তার পর প্রতিবেশীদের থেকে জানতে পারি, আমার খোঁজ করতে করতে বাড়িতে চলে এসেছিল তালিবানরা।’’
স্ত্রীকে খুন করার অভিযোগে সম্প্রতি এক ব্যক্তিকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ওই বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘সাজা শোনার পর ওই অপরাধী আমায় বলেছিল, ‘আমার স্ত্রীর যা পরিণতি হয়েছে, আমি জেল থেকে বেরোলে তোমারও একই পরিণতি হবে।’ তখন স্বাভাবিক ভাবেই ওর কথায় গুরুত্ব দিইনি। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর আমায় একাধিক বার ফোন করেছিল ও। আদালত থেকেই আমার সম্পর্কে সব তথ্য পেয়েছিল। আমায় বলেছে, খুঁজে বার করে বদলা নেবে।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমেরিকাসহ বিদেশি শক্তিগুলি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। আর সেই সাহসে ভর করেই একের পর এক তালিবান জঙ্গিদের সাজা দিয়েছিল তারা। সূত্র মতে, আফগানিস্তানে প্রায় আড়াইশো মহিলা বিচারক। বর্তমানে তাদের আর কোনও মূল্য নেই। জেল পাঠানো সেই দুষ্কৃতীরাই আজ বিজয়ী পক্ষে, শাসক। তালিবানরা ক্ষমতায় ফিরে সব কারাগারে থাকা বন্দিদের মুক্ত করেছে। আর তারা এখন নেকড়ের মতো খুঁজে বেরাচ্ছে তাদের জেল খাটানো সেই মহিলা বিচারকদের। প্রাণ হাতে করে লুকিয়ে আছেন মাত্র কয়েকদিন আগেও, সম্মানীয় বিচারপতির পদে থাকা এই আফগান মহিলারা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮১৮
আপনার মতামত জানানঃ