চীন আর যাই হোক, সমাজতান্ত্রিক নয়। বরং পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ফ্রন্টকে ভেঙে নিপীড়িত চীনকে নতুন পথে নিয়ে আসা চীনা কমিউনিস্ট পার্টিই জন্ম দিয়েছে নয়া সাম্রাজ্যবাদের। তবে চীনের এই সাম্রাজ্যবাদ মূলত পুঁজিবাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাকালে এই অবস্থা সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। সার্বিয়ান-মার্কিন অর্থনীতিবিদ ব্লাঙ্কো মিলানোভিচ ‘ক্যাপিটালিজম, অ্যালোন’ গ্রন্থে এ বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, চীন মূলত পুঁজিবাদী এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হলেও তার বেলায় মুনাফা নয়, জাতীয় স্বার্থই প্রধান। রাষ্ট্রই এখানে সর্বেসর্বা। পুঁজিবাদ এইখানে ফাঁদ; যার জাল গুটিয়ে নিতে প্রস্তুত হয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদ।
ঋণ প্রদানে চীনের একক আধিপত্য
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন চীন নিজেই বিদেশী অর্থসাহায্য নিতো। তবে এখন সবকিছুই উল্টে গেছে। এখন চীনের কাছ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ নিচ্ছে দেড় শতাধিক দেশ, এবং তার পরিমাণ শুনলে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে।
নতুন এক হিসেবে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্য প্রধান শক্তিধর দেশগুলো অন্য দেশকে উন্নয়নের জন্য যে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে তার কমপক্ষে দ্বিগুণ বেশি অর্থ দিচ্ছে একা চীন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের উইলিয়াম এ্যাণ্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র এইডডাটা-র এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ১৮ বছর সময়কালে চীন মোট ১৬৫টি দেশে মঞ্জুরি বা ঋণ হিসেবে ৮৪,৩০০ কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ দিয়েছে এবং তা খরচ হয়েছে ১৩,৪২৭টি অবকাঠামো প্রকল্পে।
কোন এক বছরে চীনের গড় আন্তর্জাতিক অর্থায়নের পরিমাণ হচ্ছে ৮,৫০০ কোটি ডলার। এর সাথে তুলনায় দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর বৈশ্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে যে সহায়তা দিচ্ছে তার পরিমাণ হলো মাত্র প্রায় ৩,৭০০ কোটি ডলার।
এই অর্থের অধিকাংশই হচ্ছে চীনের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে আসা এবং এগুলো দেয়া হয়েছে চড়া সুদে ”ঝুঁকিপূর্ণ’ ঋণ” হিসেবে।এর এক বড় অংশই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত। বিশ্ব বাণিজ্যের নতুন নতুন পথ নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে এ প্রকল্প শুরু হয়।
সমালোচকরা আশংকা প্রকাশ করেন যে চড়া সুদের যেসব ঋণ থেকে চীনের এসব প্রকল্পের অর্থায়ন হচ্ছে, তা অনেক দেশের জনগণের অগোচরেই তাদের কাঁধে বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
এখন চীনা কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন। এইডডাটার গবেষকরা চার বছর ধরে অনুসন্ধান করেছেন যে চীনের দেয়া ঋণ সারা বিশ্বে কোথায় কোথায় যাচ্ছে এবং তা কীভাবে খরচ করা হচ্ছে। তারা বলছেন, চীন সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো নিয়মিত তাদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছেন যে তাদের অর্থ বিদেশে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এইডডাটার নির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড পার্কস বলছেন, তাদের সাথে চীনের সরকারি কর্মকর্তাদের সব সময়ই কথা হচ্ছে এবং তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণভাবে তারা এসব উপাত্ত হাতে পান না।
অর্থনৈতিক শোষণ
অতীতে এক সময় আফ্রিকান দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলার জন্য দোষ দেয়া হতো পশ্চিমা দেশগুলোকে। একইভাবেই কাজ করছে চীন। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রকল্প অর্থায়নের ক্ষেত্রে চীন অনেক আগেই অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বেইজিং যেভাবে এ স্তরে উন্নীত হয়েছে তা একেবারেই ব্যতিক্রমী; বলছে এইডডাটা।
চীন এসব দেশকে অর্থ ঋণ দিচ্ছে অন্য কায়দায়। এখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে মঞ্জুরি বা ঋণের মাধ্যমে প্রকল্প অর্থায়ন করা হচ্ছে না। বরং চীন যে ঋণ দিচ্ছে তার প্রায় সবটাই আসছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ঋণ হিসেবে।
গ্রহীতা দেশের সরকারি ঋণের যে আনুষ্ঠানিক বিবরণ থাকে, তাতে চীন থেকে নেয়া এসব ঋণের কথা উল্লেখ করা হয় না। কারণ চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর সাথে করা এসব চুক্তিতে অনেক সময়ই কেন্দ্রীয় সরকারের কোন প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে না। ফলে এসব চুক্তি থেকে যায় সরকারের দলিলপত্রের বাইরে। তা ছাড়া এতে গোপনীয়তা সংক্রান্ত যেসব ধারা থাকে তার ফলেও সরকার জানতে পারে না ঋণ নেবার সময় বন্ধ দরজার ওপাশে ঠিক কী সমঝোতা হয়েছিল।
এইডডাটা বলছে, এই ধরনের অজানা ঋণের পরিমাণ ৩৮.৫০০ কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে। চীন যে সব রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ঋণ দেয় তার বিপরীতে অনেক সময় অস্বাভাবিক ধরনের কোল্যাটেরাল দাবি করা হয়। ইদানিং প্রায়ই চীনা ঋণ গ্রহীতাকে প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে পাওয়া নগদ অর্থ দেবার অঙ্গীকার করতে হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভেনেজুয়েলার সাথে একটি চুক্তি হয়েছে যাতে বলা হয়, ঋণগ্রহীতা তেল বিক্রি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা পাবে তা সরাসরি চীন-নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংকের একাউন্টে জমা দিতে হবে। ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে চীনা ঋণদাতা সাথে সাথেই এ্যাকাউন্টে থাকা সেই অর্থ তুলে নিতে পারবে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আ্যানা জেলপার্ন বলছেন, চীন এখানে বলা যায় বুদ্ধি এবং জোর খাটিয়ে তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করছে।
লাওসের দুর্গতি
চীনের দেয়া ঋণে অর্থায়িত উদ্যোগগুলোর একটা বড় উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে চীন ও তার প্রতিবেশী লাওসের মধ্যে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পটিকে।
গত কয়েক দশক ধরে রাজনীতিবিদরা এমন একটি সংযোগের স্বপ্ন দেখছিলেন, যাতে ভূ-বেষ্টিত দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হতে পারে।
কিন্তু প্রকৌশলীরা বলেছেন এ প্রকল্প হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল – কারণ এই রেললাইন পাততে হবে উঁচু পার্বত্য এলাকা দিয়ে, অনেকগুলো সুড়ঙ্গ ও সেতু বানাতে হবে। লাওস একটি গরিব দেশ এবং এ প্রকল্পের সামান্য অংশের খরচ মেটানোর ক্ষমতাও তাদের নেই।
কিন্তু চীনের উচ্চাভিলাষী ব্যাংকাররা মঞ্চে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এই চিত্রটা পাল্টে গেল। চীনের কয়েকটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি, এবং রাষ্ট্রীয় ঋণদাতাদের একটি কনসোর্টিয়াম এ প্রকল্পে সহায়তা দিলো। মোট ৫৯০ কোটি ডলারের সেই রেললাইন এখন চালু হবার পথে। ডিসেম্বর মাসেই এতে ট্রেন চলাচল শুরু হবার কথা।
তবে লাওসকে এ জন্য ৪৮ কোটি ডলারের একটি ঋণ নিতে হয়েছিল একটি চীনা ব্যাংক থেকে – যাতে ওই প্রকল্পে দেশটির যে ইকুইটি তার অর্থায়ন করা যায়।
লাওসের অর্থনীতিতে সামান্য যে কয়েকটি খাত লাভজনক – তার একটি হচ্ছে তাদের পটাশের খনি। এই খনির আয়কে কাজে লাগিয়ে দেশটি সেই বিশাল ঋণ নিয়েছিল।
হংকংএর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগী অধ্যাপক ওয়ানজিং কেলি চেন বলছেন, “লাওসের ইকুইটি অংশ অর্থায়নের জন্য চীনের এক্সিমব্যংক যে ঋণ দেয়, তাতেই বোঝা যায় চীনা রাষ্ট্র এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কতটা ব্যগ্র ছিল।”
এই রেল লাইনের অধিকাংশেরই মালিক চীনা-নিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে গ্রুপ। কিন্তু চুক্তিটা করা হয়েছে এমনভাবে যে রেলপথের ঋণের জন্য চূড়ান্তভাবে দায়ী হচ্ছে লাওস সরকার। এই চুক্তির কারণে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছে লাওসের রেটিং একেবারে নিচে নেমে যায়।
লাওসের দেউলিয়া হবার উপক্রম হলো ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন দেশটি চীনা দাতাদের ঋণের ভার হালকা করতে তাদের একটি বড় সম্পদ জ্বালানি গ্রিডের একাংশ ৬০ কোটি ডলারে চীনের কাছেই বিক্রি করে দিল। এ ঘটনা যখন ঘটছে, তখনও সেই রেললাইন চালুই হয়নি।
অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ
চীনা বিনিয়োগ ‘ট্রোজান ঘোড়া’র মতো; যা উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির আড়ালে জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রবেশ করে। এরপর দেশটিকে ‘কখনও পরিশোধযোগ্য নয়’ এমন ঋণের দিকে নিয়ে যায়। যা ‘ঋণের জাল’ হিসেবেও বহুল পরিচিত। ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ করার পর সুদসহ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ‘ডিফল্টর’ হিসেবে চিহ্নিত করাই চীনা ঋণের লক্ষ্য। সময়মত পরিশোধ না করায় ঋণ বহুগুণে বেড়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, জিবুতির কথা উল্লেখ করা যায়। চীনের কাছে দেশটির ঋণের পারিমাণ এখন তার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশেরও বেশি। অপরদিকে চীনের কাছে ইথিওপিয়ার ঋণ তার বার্ষিক আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ এবং কিরগিজস্তানের ৪০ শতাংশ বলে ধারণা করা যায়।
চীনের বিরুদ্ধে ঋণের ফাঁদ ফেলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ আছে। ‘সিএফজিডি’ নামে একটি গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষণ মতে, আটটি দেশ শিগগিরই চীনের এধরণের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছে। দেশগুলো হলো জিবুতি, কিরগিজস্তান, লাওস, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মন্টিনিগ্রো, পাকিস্তান ও তাজিকিস্তান।
শ্রীলঙ্কাও এগিয়ে আছে বেশ। একটি উচ্চাভিলাষী বন্দর উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ গ্রহণের সময় বুঝতে পারেনি বেইজিংয়ের কত ভয়ংকর ফাঁদে তারা পা দিচ্ছে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদসহ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে তারা ২০১৫ সালে বন্দর এবং এর আশেপাশের ১৫ হাজার একর জমি ৯৯ বছরের জন্য চীনকে ইজারা দিতে বাধ্য হয়।
একই ধরণের ফাঁদে পড়েছে আফ্রিকার দেশ জিবুতি। সেদেশের মূল বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ ভার চীনের কাছে হস্তান্তর করা এখন সময়ের ব্যাপার। আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ নাইজেরিয়াও চীনা ঋণ-ফাঁদ কূটনীতিতে সার্বভৌমত্ব ‘হারানোর’ আশঙ্কায় আছে। কেনিয়ারও একই পরিণতি হতে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের মতো নয়, চীনা ঋণের বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ জামানত রাখতে হয়। যেসব সম্পদের দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্য আছে। উদাহরণ হিসেবে এই হাম্বানটোটার কথাই বলা যায়। এটি ভারত মহাসাগরে ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বাণিজ্যপথের সংযোগকারী বন্দর। গরিব দেশে অবকাঠামো নির্মাণ ও অর্থায়ন করে চীন সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধাজনক ব্যবহার দাবি করে, তার মধ্যে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তেমনি বন্দরও আছে।
পাশাপাশি নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চীন স্বীয় কোম্পানিগুলোকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো সরাসরি কিনতে উৎসাহিত করে। যেমন চীন ভূমধ্যসাগরে ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারে নগদ অর্থের ঘাটতিতে থাকা গ্রিসের কাছ থেকে পিরায়েয়ুস বন্দর কিনে নিয়েছে, যেটা ইউরোপে বিআরআই প্রকল্পের ‘ড্রাগন হেড’ হিসেবে কাজ করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪৮
আপনার মতামত জানানঃ