বিপুল জনগোষ্ঠীর এইদেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখেরও বেশি নারী ও পুরুষ কর্মী যুক্ত হচ্ছে। তার তুলনায় কর্মসংস্থানের হার একেবারে কম। তাই এর বিরাট একটি অংশ প্রতিবছর কর্মহীন হয়ে পড়ে। কর্মহীন থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজে নানারকম সমস্যার সূত্রপাত হয়। তখন আমাদেরকে একরকম বাধ্য হয়েই ভাবতে হয় শ্রম অভিবাসনের কথা।
যদিও স্বাধীনতার পরপরই আমাদের দেশের নারীরা দেশের অভ্যন্তরে নানা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করে পারিবারিক স্বচ্ছলতা ও দেশের অর্থনীতিতে নিরন্তর অবদান রাখা শুরু করে। অনেক আগেই বাংলাদেশের নারী কর্মীদের শ্রম অভিবাসন শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের নারীরা সরাসরি শ্রম অভিবাসনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।
বর্তমানে প্রায় ১০ লাখের মতো বাংলাদেশি নারী প্রবাসে আছে যাদের বেশিরভাগেরই কপালে জুটছে নির্যাতন আর ঋণের বোঝা। প্রায়শই তারা সংবাদ হয়ে আসেন আমাদের সামনে। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বিরতিহীন ভাবে দীর্ঘ সময়ধরে কাজ করানো, সঠিক বেতনাদি সময়মত পরিশোধ না করা, দীর্ঘ সময় খেতে না দেওয়া, অবসর-বিনোদন-ছুটির ব্যবস্থা না করা, নিরাপত্তাহীনতা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি কারনে দেশে ফিরে এসেছেন।
নির্যাতন আর ঋণের বোঝা
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের তথ্যমতে, করোনাকালে যে রেমিট্যান্স এসেছে তার বেশিরভাগটাই এসেছে নারী শ্রমিকদের মাধ্যমে। জানা যায়, এর হিসাব প্রায় ৬৯ শতাংশ।
নারীরা তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই পাঠিয়ে দেয় দেশে। অথচ এই বিশাল অংশটিকে নিয়ে আমরা বলতে গেলে একেবারেই উদাসীন। পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশফেরত প্রায় ৩৫ শতাংশ নারীই শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের মতো সহিংসতার শিকার এবং ৪৪ শতাংশ নারীকে ঠিকমতো বেতন দেয়া হতো না।
করোনা মহামারির বছরে ২০২০ সালে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে মোট চার লাখ ২৫ হাজার ৬৯৭ কর্মী। এর মধ্যে ৫০ হাজার ৬১৯ জন নারী। আর তাদের ২২ হাজারই সৌদিফেরত। এসব নারীর বেশিরভাগই নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন বলে জানা যায়।
এদিকে, বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকের ৬০ শতাংশ বর্তমানে বেকার, ৬৫ শতাংশের নিয়মিত মাসিক কোন আয় নেই, ৬১ শতাংশ এখনও ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
এসব নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চরম অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-(বিলস) এর “দেশে ফিরে আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা”- শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকের ৫৫ শতাংশ শারীরিকভাবে ও ২৯ শতাংশের মানসিক অসুস্থতা রয়েছে এবং ৮৭ শতাংশ দেশে এসেও মানসিক অসুস্থতার কোন চিকিৎসা পায়নি।
২০২০ সালে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে মোট চার লাখ ২৫ হাজার ৬৯৭ কর্মী। এর মধ্যে ৫০ হাজার ৬১৯ জন নারী। আর তাদের ২২ হাজারই সৌদিফেরত। এসব নারীর বেশিরভাগই নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন বলে জানা যায়।
এছাড়া ৭৫ শতাংশের কোন সঞ্চয় নেই, ৭৩ শতাংশ তাদের পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং ৩৮ শতাংশ নারীকে সমাজে নিম্ন শ্রেণীর চরিত্রহীন নারী বলে গণ্য করা হয়।
সম্প্রতি বিলস দেশের তিনটি জেলার (চট্টগ্রাম, যশোর এবং ফরিদপুর) ৩২৩ জন প্রত্যাবাসী অভিবাসী নারী শ্রমিকের উপর এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। গত ২০২০ এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর এ গবেষণাটি সম্পন্ন হয়।
নিয়মিত ধর্ষিত হচ্ছেন নারী কর্মীরা
গৃহকর্মী হিসেবে গেলেও অনেক নারীই গৃহকর্তাদের লোভের শিকার হয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার সেসব নারীদের কেউ কেউ আবার সন্তানও জন্ম দিচ্ছে। ছয় মাস বয়সী সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন এক প্রবাসী নারী।
স্বামী তালাক দেয়ায় দুই সন্তানকে দেশে আত্মীয়ের কাছে ফেলে রেখে বিদেশে যায় কর্মের সংস্থান করতে অথচ সেই দেশে গিয়েও শেষরক্ষা হয়নি তার। ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছে অথচ সেই সন্তানের পরিচয় দিতে রাজি নয় জন্মদাতা।
এমন অবস্থায় পড়েছে আরও অনেক নারী, যারা ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে পায়নি সন্তানের জন্মদাতার স্বীকৃতি। আইন আদালত করেও সুরাহা হয় না। শেষ পর্যন্ত নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে জন্ম দেয়া সন্তানকে বিক্রি করে দিয়ে কোনোরকম দেশে ফিরে আসছে।
কতজন নারী কাজ করতে গিয়ে সন্তানসহ ফিরে আসছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সন্তান পেটে করে বা সন্তান নিয়ে ফিরে আসা নারীরা সামাজিকভাবে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। এমন কিছু নারী নানা বেসরকারি সংস্থার অধীনে আশ্রিত আছে বলেও জানা যায়।
অথচ এদের কি এমন আশ্রিত হবার কথা ছিল? নিজের আত্মমর্যাদার বিনিময়ে রেমিট্যান্স পাঠানো নারীদের প্রতি এমন অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সন্তানদের ভবিষ্যৎই বা কী হবে? একজন মা কতটা অসহায় হলে নিজের জন্ম দেয়া সন্তানকে প্রবাসে ফেলে রেখে পালিয়ে আসে?
বিমানবন্দরে মালামাল আনার বেল্টের কাছে একটি শিশুকে পাওয়া গেছে যার পরিচয় কেউ জানে না। ধারণা করা হচ্ছে কোনো মা হয়তো বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর পরিচয়হীন সন্তানকে ফেলে রেখে গেছে।
সন্তান নিয়ে ফিরে আসা মায়েদের পুনর্বাসনের দায় বা দায়িত্ব আসলে কার? তারাতো সকল রকম বৈধ নিয়মের মাধ্যমেই বিদেশ গিয়েছিল অথচ ফিরে আসার পর এদের দায়িত্ব নিতে চাইছে না কেউ। কেন? এদের বিষয়ে সরকারকেই ভাবতে হবে, নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ।
কাজ করতে গিয়ে যারা নানা প্রকার নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদেরকে আইনি সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। যেসব নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে তাদের হয়ে আইনি লড়াই করার জন্য নিতে হবে পদক্ষেপ, কারণ তাদের কারো পক্ষেই ভিনদেশে আইনি লড়াই করা বা সন্তানের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। অন্তত জন্ম নেয়া শিশুটিরতো কোনো অপরাধ নেই। সে কেন জন্মের পর পরই এতিমের খাতায় উঠে যাবে?
কেস স্টাডি
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন হবিগঞ্জের সালমা (ছদ্মনাম)। মাত্র ১৫ দিনেই ভেঙে যায় তার সুখস্বপ্ন। গৃহকর্তার নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে চলে এসেছেন দেশে।
কিন্তু দেশে এসে আরেক বিরূপ অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় এই নারীকে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে আগেই, সন্তানদেরও কাছে পাচ্ছেন না। নিজের জন্মদাতাও তাকে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অনিশ্চয়তায় তাই সালমার দিন কাটছে নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে।
সৌদি আরবে গৃহকর্তার নির্যাতনে প্রসঙ্গে তিনি জানান, চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে রেখে আসার কথা বললে গৃহকর্তা তা করেনি, উল্টো বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সালমা বলেন, “খানা দেয় না, মারপিট করে। চামুক (চামচ) আছে না? চামুক দিয়ে মারে। অনেক ধরনের কথা বলত। খারাপ কথাও বলত। আমি ওর খতা (কথা) শুনি নাই দেইখ্যা আমারে মারছে।”
“একদিন আমারে কফি জ্বাল দিবার হতা (কথা) বলছে। কফি জ্বাল দিতাম গেছি। ও আমার পিছে পিছে গেছে। গেছে বাদে আমি টের পাইছি, বাদে আমি সইরা গেছি। আমারে অনেক ধরনের কথাবার্তা কইছে। এর বাদে আমার হাতে দরছে, হাতে দইরা নিচে ফালায়া দিছে। আমি কফি জ্বাল দিতে আছিলাম, আমার আতে (হাতে) ম্যাচ লাইট আছিল। ম্যাচ টোকা দিয়া ব্যাডার পাঞ্জাবিত লাগায়া দিছি।”
সালমা জানান, এরপরই নিজের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। বাসা ছেড়ে এসে রাস্তায় কয়েকজন বাঙালিকে পেয়ে জানান দেশে ফেরার আকুতির কথা।
“বাঙালিদের বলছি, আমি দেশে যাইয়াম। কয় দেশে যাওয়ার দরহার (দরকার) নাই, অ্যাম্বাসিতে লও বাদে আমরাও যায়াম অ্যাম্বাসিতে। অনেক ধরনের মেয়েরা আছে অ্যাম্বাসিতে। অনেকে দেখছি কেউর পাউ (পা) বাঙ্গা (ভাঙা), কেউর আত (হাত) বাঙ্গা, অনেক মেয়েরে ইস্তারি (ইস্ত্রি) লাগায়া দেয় শইল্য (শরীরে)।”
সালমা জানান, দেশে ফেরার পর সন্তানদের কাছে ফিরতে পারছেন না, কারণ তার বাবা শামসু মিঞাই তাকে পরিবারে ঠাঁই দিচ্ছেন না। এ বিষয়ে জানতে শামসু মিঞার বলেন, মেয়েকে নিষেধ করার পরও সৌদি আরব গিয়েছিল। তার উপর কোনো যোগাযোগ করেনি।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান। নির্যাতনের শিকার নারীদের পরিবার ফেরত নিতে না চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “পরিবারগুলোর সাথে কথা বলে দেখেছি, আমাদের সোসাইটি মনে করে সৌদি আরব থেকে কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে একটা মেয়ে টর্চারড হয়ে এসেছে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছে, এক অর্থে তারা মনে করে অচ্ছুত, খারাপ। সমস্ত দায়টা যেন মেয়ের। সমাজ তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে না।”
প্রবাসে নারীকর্মী
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ থেকে নারীকর্মী প্রেরণ শুরু হলে প্রথম বছরই ২১৮৯ জন নারী কর্মী বিদেশে গমন করে। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল এই সংখ্যা কোনভাবেই দুই হাজারকে অতিক্রম করতে পারেনি। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে মোট ২৪১৮ জন নারীকর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। আবার ২০০৪ সাল থেকে এই সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়তেই থাকে।
প্রসঙ্গত ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের নারীকর্মীদের সৌদিআরবে কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধই ছিল। ২০১৫ সালে সৌদির শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার ফলে ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ সালে নারীকর্মীর বিদেশ গমনের সংখ্যা রাতারাতি লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই বছরে মোট ৩ লক্ষ ৪৩ হাজার ৮৩২ জন নারীকর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গিয়েছে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার নারীকর্মী।
১৯৯১ সাল ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬৯৫ জন নারী কর্মী বিদেশে গমন করেছে। উল্লেখ্য ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণ বাড়ীয়া, যশোর, বরিশাল, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের নারীকর্মীদের বিদেশে গমনের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ সরকার নতুন করে হংকং, জর্ডান, লেবানন, ওমানসহ কয়েকটি দেশের সাথে বিভিন্ন সেক্টরে নারীকর্মী প্রেরনের কার্যক্রম সংক্রান্ত চুক্তি করেছে। অন্যান্য দেশেও নারী কর্মী প্রেরনের জন্য বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বিস্তারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
পুরুষকর্মীর তুলনায় নারীকর্মীর শ্রম অভিবাসন একটু কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। সিডও সনদের ১১.৫ নং ধারায় অভিবাসী নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে সমঅধিকার ও সমমর্যাদা সম্পর্কে বলা আছে-স্বাক্ষরকারী সদস্য রাষ্ট্রসমুহকে নারীকর্মীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তারপরেও বিভিন্ন দেশে নারী কর্মীদের হয়রানি ও নির্যাতনমূলক ঘটনা ঘটছে।
গবেষক ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য
গবেষণা উপ-পরিচালক মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, “পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ গিয়ে ২৩ শতাংশ নারী শ্রমিক এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশে ফিরেছেন, ১৮ শতাংশ এক বছরের সামান্য বেশি সময় থেকেছেন, ৫৫ শতাংশেরদেশে ফেরত আসা ছিল জবরদস্তিমূলক।”
তিনি আরো বলেন, দেশে ফেরত আসা প্রতি ৩ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে ১ জনের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে অবনতি হয়েছে এবং তাদের সিংহভাগই ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৮৫ শতাংশ তাদের বর্তমান কাজ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত এবং ৫৭ শতাংশ তাদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে চিন্তিত।
“পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ গিয়ে ২৩ শতাংশ নারী শ্রমিক এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশে ফিরেছেন, ১৮ শতাংশ এক বছরের সামান্য বেশি সময় থেকেছেন, ৫৫ শতাংশেরদেশে ফেরত আসা ছিল জবরদস্তিমূলক।”
যশোর ফেরত এক প্রবাসী নারীর কন্যা চম্পা বলেন, “আমার মা দেশের বাইরে যাওয়ার আগে আমাদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। এখন খুবই দুঃসময়, কখনো খাই, কখনোবা না খেয়ে থাকতে হয়।”
ফরিদপুরের মমতাজ নামের এক বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকের মা বলেন, “আমার মেয়ে খুবই অসুস্থ। বিদেশে থাকার সময় ওকে দেশে কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। না খাইয়ে রাখা হয়, এভাবে কিছুদিন চলার পর সে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে।”
গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে যাওয়া ৫২ শতাংশ নারীকে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়, ৬১ শতাংশ খাদ্য ও পানির অভাবে ভুগেছেন, ৭ শতাংশ যৌন এবং ৩৮ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাটির পরিচালক নাজমা ইয়ামিন বলেন, “বর্তমানে বেশিরভাগেরই পরিবার বা সমাজে মতামতের কোন মূল্য নেই। তাদের কেউ গ্রাহ্য করে না।কেউ বিশ্বাস করে না। বিদেশ থেকে ফেরার সময় পরিবারের সদস্য দ্বারা বিমানবন্দরেই অযাচিত আচরণের শিকার হয়েছেন ১৭ শতাংশ নারী শ্রমিক। ১৫ শতাংশ বিদেশ থেকে ফিরে আসা নারী তালাকপ্রাপ্ত হয়েছেন। ১১ শতাংশ নারী শ্রমিকের স্বামী তাদের ছেড়ে চলে গেছে এবং ২৮ শতাংশ দাম্পত্য জীবনে বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছেন।”
তবে ব্যাপক নিপীড়ন-নিযাতন সহ্য করেও কিছু কিছু বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিক তাদের অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদেরই একজন যশোরের নিলুফার বেগম বলেছেন, “সেখানে অনেক সমস্যার মুখে পড়েছি। ছোটখাটো ভুল হলেই আমার চাকরিদাতা মারপিট করতো। তাই সেখান থেকে পালিয়ে যাই, কিন্তু আমার দরকারি সব কাগজ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বিদেশে থাকা দেশের মানুষও একবার আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। কিন্তু আমি আশা হারাইনি, আমার সংকল্প ছিল- নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা না বদলে দেশে ফিরব না।”
এনিয়ে জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আবুল হোসেন বলেন, বিদেশে সবচেয়ে বেশি শারীরিক, মানসিক এবং যৌন সহিংসতার শিকার হয় নারী গৃহকর্মীরা, যার সিংহভাগই ঘটে মধ্যপ্রাচ্যে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ সমস্ত দেশকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও’র আইন আনুযায়ী আচরণ করতে বাধ্য করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯২১
আপনার মতামত জানানঃ