বেঁচে থাকার জন্য যেসব পণ্য বেশি দরকার, সেসব পণ্যের দামই বেড়েছে। অর্থাৎ চালের দাম আবারও বেড়েছে। বেড়েছে আটা-ময়দার দামও। দাম বাড়ার প্রবণতা থেকে বাদ পড়েনি চিনিও। শুধু তা-ই নয়, ডালের দামও বেড়েছে। বাড়ার তালিকায় রয়েছে ডিম ও মুরগির দাম। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের তুলনায় এসব পণ্যের দাম নতুন করে বেড়েছে। এ ছাড়া সবজি, মাছ, আলু, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের দামও বাড়তি। নাগালের বাইরে রয়েছে মাংসের দাম। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষ। দরকারি এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা জমানো সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন।
বেড়েছে মুরগি ও ডিমের দাম
এক দৈনিক থেকে জানা যায়, আজ প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৫৬-১৭০ টাকা। আগের সপ্তাহে যা বিক্রি হয়েছে ১৫০-১৫৫ টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি প্রতি ব্রয়লারের দাম বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। আর এক মাসে কেজিতে মুরগির দাম বেড়েছে ৪৫-৫০ টাকা। এক মাস আগে ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১২০-১২৫ টাকা।
ব্রয়লারের মুরগির চেয়ে বেশি বেড়েছে সোনালী মুরগি বা পাকিস্তানী ককের দাম। গত সপ্তাহে ২৯০ টাকায় বিক্রি হওয়ার মুরগিগুলো আজ বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩১০ টাকা দরে। এক মাস আগে এসব মুরগির দাম ছিল ২১০ টাকা ২২০ টাকা। মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১০০ টাকা।
মুরগির পাশাপাশি বেড়েছে ডিমের দামও। খুচরা বাজারে এক পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১০-১১ টাকায়। আর ডজন বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকায়।
রামপুরা বাজারে ব্যবসায়ী জমির আহমেদ ওই দৈনিককে বলেন, লকডাউন খুলে দেওয়ার পর থেকে মুরগির দাম বাড়তি। মাসখানেক আগেও মুরগি ১২০ টাকা এখন ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। এখন দাম বাড়ছেই, কমবে বলে মনে হয় না।
তিনি বলেন, এখন অফিস-আদালত, কল-কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। সেই কারণে মুরগির চাহিদাও বেড়েছে। চাহিদা বাড়ায় দাম বাড়ছে।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় মুরগির পাইকারি বাজার কাপ্তান বাজার। এই বাজারের ব্যবসায়ী আলী হোসেন বলেন, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর থেকে হোটেল-রেস্তোরাঁয় মুরগির চাহিদা বেড়েছে। সেই তুলনায় মুরগি আমদানি নেই। তাই দাম বাড়ছে।
আমদানি কমার পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হয়েছে। এতে অনেক খামার নষ্ট হয়েছে। তাই চাহিদার তুলনায় মুরগি আমদানি কমেছে।
সবজির দাম বেড়েছে
রাজধানীর টাউন হল কাঁচাবাজার, গুলশান-১ কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে গোল বেগুন, ছোট করলা, শসা, বরবটি ও চিচিঙ্গা ৭৫-৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও এসব সবজি ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।
বেড়েছে ঝিঙে, ঢ্যাঁড়স, ধুন্দুল, লম্বা বেগুন ও লম্বা করলার দামও। গত সপ্তাহে ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া এসব সবজি এখন ৫৫-৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন সবজি বিক্রেতারা। এ ছাড়া বাজারে আসা আগাম শিমের দাম ১২০-১৪০ টাকা।
করোনা পরিস্থিতিতে টালমাটাল গোটা বিশ্ব, যার ছায়া পড়েছে অর্থনীতিতেও। লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। এ কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। চালের পাশাপাশি ডাল, আটা, চিনি, তরকারি, মাছ, মাংসের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র, খেটে খাওয়া ও অসহায় মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।
মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের সবজি বিক্রেতা আবু নাঈম বলেন, বছরের এই সময়ে (সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে) সবজির দাম একটু বেশি থাকে। কারণ, এই সময়ে গ্রীষ্মকালীন সবজির উৎপাদন প্রায় শেষের দিকে থাকে। আবার শীতের সবজিও এই সময়টাতে বিক্রির মতো উপযুক্ত হয় না। তখন বাজারে একধরনের সংকট তৈরি হয়।
মিরপুর ১১ নম্বর বাজারের সবজি বিক্রেতা আলআমিন বলেন, বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সবজির সাপলাই কম। সাপলাই বাড়লে সবজির দাম কমবে। বাজারে সবজির দাম গতকালকে একরকম থাকে, তার পরের দিন আরেক রকম। সবজির দাম কখন কি থাকবে, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।
এ সব বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা কেজি। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। বাজারে বেড়েছে কাঁচামরিচের দাম। কেজিতে দাম বেড়েছে ৬০ টাকা।
প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। গতসপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা কেজি। কাঁচা কলার হালি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। পেঁপে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। শসা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৬০ টাকায়। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়।
এছাড়া শুকনা মরিচ প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, রসুনের কেজি ৮০ থেকে ১৩০ টাকা, আদা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। হলুদ ১৬০ টাকা থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইন্ডিয়ান ডালে কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। দেশি ডাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়।
বেড়েছে মাছের দাম
অন্যদিকে, মাছের বাজারেও প্রতিটি মাছ তুলনামূলক বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। বাজারে পাঙ্গাশ প্রতি কেজি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। শিং মাছ (মাঝারি) ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, কই মাছ ২০০ থেকে ২২০ টাকা, চিংড়ি প্রকারভেদে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা, ইলিশ (বড়) পিস ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা, ইলিশ (ছোট) পিস ৬৫০ থেকে ৭৫০, এক কেজি ওজনের ইলিশ ১২০০ টাকা, রুই মাছ ২৭৫ থেকে ৩০০ টাকা, কাতল ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা, তেলাপিয়া ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বেড়েছে চাল ও ভোজ্যতেলের
গত সপ্তাহের তুলনায় বাজারে সব রকমের চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ২ টাকা থেকে ৫ টাকা। মোটা চাল কেজি প্রতি ৪৫ টাকা থেকে ৪৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহে ছিল কেজি প্রতি ৪৪ টাকা। নাজিরশাইল মান ভেদে ৬৫ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত সপ্তাহে যার দাম ছিল ৬২ থেকে ৮০ টাকা। পাইজাম ৪৭ থেকে ৫০ টাকা। গত সপ্তাহের মূল্য ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। মিনিকেট ৬০ থেকে ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। আটাশ চালের বর্তমান দাম ৪৮ থেকে ৫২ টাকা হলেও গত সপ্তাহের দাম ছিল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা।
কোম্পানি ভেদে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়, যার দাম গত সপ্তাহে ছিল ১৪৫ টাকা। ২ লিটার ২৯৫ থেকে ৩০০ টাকা। গত সপ্তাহে ছিল ২৮৭ থেকে ২৯০ টাকা। আর ৫ লিটার তেলের বর্তমান দাম ৭১৮ থেকে ৭৪৫ টাকা। যার দাম ছিল ৭১০ থেকে ৭৩০ টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে টালমাটাল গোটা বিশ্ব, যার ছায়া পড়েছে অর্থনীতিতেও। লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। এ কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। চালের পাশাপাশি ডাল, আটা, চিনি, তরকারি, মাছ, মাংসের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র, খেটে খাওয়া ও অসহায় মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।
তারা বলেন, শুধু দরিদ্র মানুষ নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও নানারকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। বস্তুত কিছু অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ী বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আটকে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে।
সরকারকে এ অসাধু ও অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
এক্ষেত্রে বাজারে মনিটরিং বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, অনিয়ম প্রমাণিত হলে বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী অসৎ ও অনৈতিকভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ায় তাদের কাছ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শুধু জরিমানা আদায় নয়, তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের মতো ব্যবস্থাও নিতে হবে। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে।
তারা বলেন, বাজারে দোকানের সামনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তালিকা টাঙ্গিয়ে রাখতে হবে। এসবের পাশাপাশি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত ও সরবরাহ বাড়াতে হবে, যাতে করে কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি না হয়। ব্যবসায়ী সমাজকে অসাধুতা এবং অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশা পরিহার করে সঠিক ও সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। সরকারের কঠোরতা এবং ব্যবসায়ীদের সচেতনতা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ