দুনিয়ার সব জাতিই তার নিজ অঞ্চলের আবহাওয়া, ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি আর ইতিহাস-ঐতিহের সঙ্গে মিল রেখে নিজস্ব রীতি পোশাকের একটি পরিচয় তৈরি করে নিয়েছে।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ফ্যাশন রীতিও তার গতি আর বাঁক বদলায় নদীর মতো। তবে একক জাতির ধাঁচ আর বৈশিষ্ট্য একেক যুগে একেক রকম রূপ নেয়। অর্থাৎ মূল বৈশিষ্ট্য ঠিক থেকে কিছুটা বদলে যায় এর রং,ঢং, আঙ্গিক আর সৌকর্য শৈলী।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফ্যাশন ট্রেন্ডেও পরিবর্তন আসে। তবে ফ্যাশন ট্রেন্ডের স্রোতে গা ভাসানোর ফলাফল যদি হয় মারাত্মক, তাহলে তা বিপজ্জনক ছাড়া আর কিছুই নয়। যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন সব ফ্যাশন অনুষঙ্গের চল এসেছে, যা মানুষের জন্য খুবই বিপজ্জনক। ক্রিনোলিন ফ্যাশন ট্রেন্ড তেমনি একটি। ক্রিনোলিন পরার কারণে অতীতে অনেক নারীর মৃত্যু ঘটেছে! এজন্যই একে ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক ফ্যাশন ট্রেন্ড বলে অভিহিত করা হয়েছে।
আঠারো শতকের প্রতিটি সিনেমা সেটের জন্য যদি কোনো ‘মাস্ট হ্যাভ’ পোশাকের কথা উল্লেখ করতে বলা হয়, তাহলে কোনো সংশয় ছাড়াই ক্রিনোলিনের নাম বলে দেওয়া যায়। আরসি মিলিয়েট উদ্ভাবিত ক্রিনোলিনকে ইতিহাসের আরেকটি অন্যতম ডেডলি ফ্যাশান ট্রেন্ড হিসেবে ধরা হয়। ক্রিনোলিন মূলত হর্সহেয়ার এবং স্টিলের একধরনের ফ্রেম, যা নারীদের স্কার্ট বা পোশাককে বিশালাকৃতি প্রদান করতো। এই পোশাক কেবল অস্বস্তিদায়ক ছিল না, স্টিলের ফ্রেমের কারণে কোথাও বসা বা দরজা দিয়ে বের হওয়া অসম্ভব ছিল। শুধু কি তা-ই, বাতাসের সামনে পরলে তো আর রক্ষে থাকতো না!
১৮৫৬ সালে আরসি মিলিয়েট এই ভয়ঙ্কর পোশাকটির উদ্ভাবন করেন। ভিক্টোরিয়ান পোশাক ক্রিনোলিন ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক ফ্যাশন ট্রেন্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইতিহাস বলছে, ভয়ঙ্কর এই পোশাক পরে প্রায় ৩০০০ নারী মারা যান। যার মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম ওয়াইল্ডের কন্যা এমিলি এবং মেরি। যারা ক্রিনোলিন গাউন পরিহিত অবস্থায় পোশাকে আগুন লেগে পুড়ে মারা যান।
১৯ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যে গোলাকার এই গাউন পরার একটা জনপ্রিয়তা ছিল। সেখানে বিভিন্ন হাই প্রোফাইল মৃত্যুর কারণ ছিল গাউনে আগুন। কবি হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার স্ত্রীর গাউনে আগুন লাগার কারণে তাকে গাউন খুলে ফেলতে সাহায্য করেছেন।
ওসকার ওয়াইল্ডের দুই বোনও গাউনে আগুন লাগার কারণে মারা যান। তখন তারা আগুনের খুব কাছে থাকার করণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮৫৮ সালে গড়ে প্রতি সপ্তাহে তিনজন গাউনে আগুন লাগার কারণে মারা যান। ওই সময় তাদের চলাফেরা ও আচরণে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না বলেই এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল।
ক্রিনোলিন পোশাকগুলো অনেক ঘের ও কয়েক স্তরের হয়ে থাকে। এ জাতীয় পোশাকের কাপড় সাধারণত টিস্যু বা সিল্কের হয়ে থাকে। যাতে সহজেই আগুন লেগে যেতে পারে। খুব সাধারণভাবে ফায়ারপ্লেস বা আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও এই পোশাকে আগুন ধরে যাওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা থাকতো। এখানেই শেষ নয়, এই বিশালাকারের খাঁচাকৃতির পোশাকের কারণে কোনো বিল্ডিংয়ে আগুন লেগে গেলে জীবন বাঁচাতে যে পালাতে চাইবেন, তারও উপায় ছিল না।
এ ছাড়াও এ পোশাক পরে হাঁটতে গিয়ে অনেকেই পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এমনকি যানবাহনের গাড়ির চাকায় জড়িয়েও অঘটন ঘটেছে অনেক। ক্রিনোলিন গাউন পরলে তা বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে এটি পরে বাইরে বের হলে চলাচল করার সময় যেকোনো বিপদ ঘটতে পারে।
১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের দিকে ক্রিনোলিন এতটাই বড় ঘের সৃষ্টিকারী পোশাকে রূপান্তরিত হয়েছিলো যে, তা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই দুই শতকে ইংল্যান্ডে তিন হাজার নারী ক্রিনোলিন সৃষ্ট আগুনে পুড়ে মারা যায়। ক্রিনোলিন দ্বারা সৃষ্ট সবচেয়ে কুখ্যাত অগ্নিকাণ্ড ঘটে ১৮৬৩ সালে চিলির ‘দ্য চার্চ অফ দ্য কোম্পানি অফ জেসাস ইন সান্টিয়াগো’-তে, আনুমানিক তিন হাজার মানুষ ওই কক্ষে মারা যায় একমাত্র অগ্নিদাহ্য ক্রিনোলিন থাকার কারণে।
ছবি: www.rarehistoricalphotos.com
এসডব্লিউ/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ