আফগানিস্তান তালিবানের দখলে যাওয়ার পর আফগানদের ওপর তালিবান কী কী করতে পারে তার একটি অনুমান পূর্ব থেকেই ছিল। নারীদের অধিকার বঞ্চিত করার পাশাপাশি তালিকায় সংগীতও ছিল। তালিবান বাহিনী মুখে উদারনীতির কথা যতই বলুক না কেন, তারা তাদের নতুন শাসনেও আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এবারও দেশটিতে গান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তালিবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ বলেন, ‘ইসলামে সংগীত নিষিদ্ধ…তাই আশা করছি, আমরা লোকজনকে এ ধরনের কর্মকাণ্ড না করার বিষয়টি বোঝাতে পারব।’
নব্বইয়ের দশকে তালিবান শাসনকালে দেশটিতে সংগীত, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র কড়াভাবে নিষিদ্ধ ছিল। আর কেউ এই নিয়ম অমান্য করলে তাকে গুরুতর শাস্তি পেতে হতো।
কিন্তু ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটিতে সংগীতচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে। সেখানে প্রচুর কনসার্ট ও উৎসব হতো। এমনকি আফগানিস্তানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মিউজিক প্রতিষ্ঠা হয়, সেখানে নানা অনুষ্ঠানও উদ্যাপন করা হয়। পাশাপাশি দেশটির সব নারী অর্কেস্ট্রা দেশে ও বিদেশে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
সেসব এখন কেবলি স্মৃতি হতে চলেছে। তালিবানের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন সংগীত শিল্পীরা।
ইতোমধ্যে বিবিসির খবরে পাওয়া গেছে, আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে যেতে বাধ্য হয়েছেন অনেক আফগান সংগীত শিল্পী। তারা বলছেন, তাদের কোনো উপায় ছিল না। তারা অবৈধভাবেই পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন। এখন লুকিয়ে আছেন। এমন ছয় সংগীতশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।
এই সংগীতশিল্পীদের অনেকে এখন পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছেন। পাকিস্তানে পালানো সংগীতশিল্পীদের একজন বিবিসিকে বলেছেন, তিনি যদি আফগানিস্তানে থেকে যেতেন, তবে তাকে মেরে ফেলা হতো।
গত জুনে আফগানিস্তানের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা নাজার মুহাম্মদ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। নাজারের পরিবার অভিযোগ করে, তাকে সশস্ত্র গোষ্ঠী তালিবানের সদস্যরা হত্যা করেছে। কিন্তু এ নিয়ে মুখ খোলেনি গোষ্ঠীটি।
পাকিস্তানে পালিয়ে আসাদের মধ্যে এক আফগান সংগীত শিল্পী খান (ছদ্মনাম)। ২০ বছর ধরে রাজধানী কাবুলে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গাইতেন তিনি। তার সুনামও রয়েছে বেশ। তালিবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তার সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে। তাকে ধরতে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ চালায়। প্রাণ ভয়ে পরিবার নিয়ে কোনও রকম পাকিস্তানে প্রবেশ করেন তিনি।
খান বলেন, ‘মধ্যরাতে আমার অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী আমাকে টেলিফোনে জানান, কয়েকজন অস্ত্রধারী এসে সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলেছে। তারা এখনো অফিসে আছে। আপনাকে খুঁজছে।’
ঠিক এর পরদিনই খুব ভোরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাবুল ছেড়ে চলে যান খান। এখন তিনি বলছেন, তালিবান সম্পর্কে তিনি যে ধারণা পোষণ করেছিলেন, তা ভুল ছিল।
এই শিল্পী ও সংগীত পরিচালকেরা তোরখাম ও চামান সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে পালিয়েছেন। ইসলামাবাদ ও পেশোয়ারে শহরতলি এলাকায় পালিয়ে রয়েছেন কয়েকজন। পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে পথ খুঁজছেন তারা।
এমনই আরেক শিল্পী হাসান (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, তালিবান তাকে ধরতে পারলে মেরে ফেলত। কারণ, তিনি আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীর জন্য গান গেয়েছিলেন। বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডিতে এক বন্ধুর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। তালিবান ক্ষমতা দখলের পর পরিবারের সদস্যদের আফগানিস্তানে রেখেই পালিয়েছেন তিনি।
আফগানিস্তানে গত ২০ বছরের পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার ব্যবস্থায় রাজধানী কাবুল ও অন্যান্য নগরীতে গড়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত এক জনপ্রিয় সংস্কৃতি। বডিবিল্ডিং, রকমারি চুলের স্টাইল, জোর আওয়াজে পপ গান কত কী-ই না চলেছে! তুর্কি সোপ অপেরা থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠান এবং টিভিতে ‘আফগান স্টার শো’ হয়েছে বহুল জনপ্রিয়। এখন রাতারাতি বদলে যেতে শুরু করেছে সে সবকিছুই।
পালিয়ে যাওয়া শিল্পীদের আরেকজন আখতার। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ারে অবস্থান নিয়েছেন তিনি। সেখানে যেতে তার পাঁচ দিন লেগেছে। তিনি বলেন, তার সাত বছরের মেয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত। আখতার বলেন, ‘এই পথ পাড়ি দিতে আমার জীবনের কথা চিন্তা করিনি। আমি মেয়ের জীবন নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।’
তালিবান যে শুধু কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, এমনটা নয়। কোনো শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেখানকার এফএম রেডিও স্টেশনেও গান প্রচার বন্ধ করে দেয় তারা।
এ প্রসঙ্গে মোবি মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক মাসুদ সানজের বলেন, ‘সাধারণত আমাদের রেডিও এবং টেলিভিশনে সংগীতানুষ্ঠান প্রচার করতাম। কিন্তু তালিবান নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আমরা আর এসব প্রচার করছি না।’
২৪ ঘণ্টা সংগীত প্রচারের একটি স্টেশন ছিল তাদের। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে যাওয়ার পর এই স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিনোদন চ্যানেলে এখন শুধু “নাত” প্রচার করা হচ্ছে।’
আফগানিস্তানে গত ২০ বছরের পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার ব্যবস্থায় রাজধানী কাবুল ও অন্যান্য নগরীতে গড়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত এক জনপ্রিয় সংস্কৃতি। বডিবিল্ডিং, রকমারি চুলের স্টাইল, জোর আওয়াজে পপ গান কত কী-ই না চলেছে! তুর্কি সোপ অপেরা থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠান এবং টিভিতে ‘আফগান স্টার শো’ হয়েছে বহুল জনপ্রিয়।
এখন রাতারাতি বদলে যেতে শুরু করেছে সে সবকিছুই। গানে গানে মুখরিত থাকত যে আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মিউজিক, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে যেখানে গান শিখত; সেই স্কুলের দরজা এখন বন্ধ। স্তব্ধ হলরুমে পড়ে আছে বাদ্যযন্ত্র। সেখানে এখন তালিবানের আনাগোনা।
শরিয়া আইন অনুযায়ী যেন সব হয় তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে তালিবান। কাবুলের কাছের লেগমান প্রদেশের এক সাংবাদিক জানান, তালিবানের স্থানীয় সাংস্কৃতিক কমিশন রাষ্ট্র-পরিচালতি একটি রেডিও এবং ৬ টি বেসরকারি রেডিও স্টেশনকে শরিয়া আইনানুযায়ী অনুষ্ঠান করতে বলেছে।
কান্দাহারে তালিবান কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবেই নির্দেশ দিয়ে রেডিও স্টেশনগুলোকে গান-বাজনা এবং নারী কণ্ঠের ঘোষণা বন্ধ করতে বলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৩
আপনার মতামত জানানঃ