করোনা মহামারিতে গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর অব্দি স্কুল বন্ধ থাকায় ২৫ লক্ষ শিক্ষার্থী নিয়ে ১৫ হাজার স্কুল চিরকালের মত বন্ধ হয়ে গেছে। এসব বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলের শিক্ষার্থীরা বছরের মাঝামাঝি এসে অন্য স্কুলে ভর্তিও হতে পারবে না। স্কুল খুলে দেয়ার পর এই ২৫ লক্ষ শিক্ষার্থী পড়েছে চরম সংকটে।
তথ্যমতে, করোনার আগে ৬০ হাজার স্কুল, কিন্ডারগার্ডেন ছিল। এসব স্কুলে ১ কোটি ছাত্র ও ১০ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী ছিল। স্কুল খোলার পরও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে আংশিক কার্যক্রম, শিক্ষার্থী উপস্থিতিও তুলনামূলক কম। এদিকে, ১৫০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে স্কুলগুলো, তবে নাকচ করে দিয়েছে সরকার।
লোকসানের কারণে স্থায়ীভাবে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
মহামারির কারণে গত বছরের মার্চ থেকে দেশের আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বন্ধ ছিল ঢাকার গুলশানের লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমিও। এ সময় ৩০ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে এ বছরের মার্চে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
স্কুলের মালিক এবং প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ঢাকা ছেড়ে জামালপুরে তার পৈতৃক বাড়িতে চলে যান। রাজধানী ছাড়ার আগে তিনি তার স্কুলের ৩৫০ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীকে অন্য স্কুলে ভর্তি হতে বলেন। যদিও তিনি জানতেন, শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময়ে নতুন কোথাও ভর্তি হওয়াটা সহজ হবে না।
ঢাকার এই স্কুলের মতো অর্থসঙ্কটে বন্ধ হয়ে গেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ভিশন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বন্ধ হয়ে যায় স্কুলটি। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে স্কুলটির ৪৫০ শিক্ষার্থীর ভাগ্য।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্ডেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, মহামারির আগে কিন্ডারগার্ডেনের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার। এসব স্কুলে প্রায় ১ কোটি ছাত্র এবং ১০ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারী ছিল।
ইকবাল বাহার জানান, অবশিষ্ট ৪৫ হাজার কিন্ডারগার্ডেন ফের খুলতে পারলেও শিক্ষার্থী উপস্থিতি ৬০ শতাংশের চেয়ে কম। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়মিত উপস্থিতির হার গড়ে ৯০%-৯৫% ছিল।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। কেউ কেউ শিশু শ্রমিক হয়েছে, আবার অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।’
শিক্ষকরা অন্যান্য পেশায় চলে গেছেন
অর্ধেক শিক্ষক অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও গুরুতর শিক্ষক সংকটে ভুগছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এল ফুলকুঁড়ির প্রধান শিক্ষক মো. তাকবীর জানান, ‘স্কুল ফের চালু করলেও শিক্ষক সংকটের কারণে তিনি ঠিকমতো শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছেন না।’
তিনি বলেন, কয়েকজন স্নাতকোত্তীর্ণকে আমার স্কুলে যোগ দিতে বলেছিলাম। কিন্তু বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরির নিরাপত্তা নেই, এ কথা বলে তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্ডেন অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি-জেনারেল মিজানুর রহমান সরকার বলেন, ১০ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারী এত কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন যে, তাদের অনেককেই বেঁচে থাকার জন্য দিনমজুরের হিসেবে কাজ করতে হয়েছে।
কিন্ডারগার্ডেনগুলোকে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেই
শিক্ষকদের মতে, ১২ সেপ্টেম্বর ফের চালু হওয়া অর্ধেক বেসরকারি স্কুলগুলোর অন্তত অর্ধেক স্কুলই আর্থিক চাপের কারণে আংশিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, আংশিক কার্যক্রমের ফলে পাঠদান ও শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে।
মহামারির ধাক্কা সামলানোর জন্য বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্ডেন গুলো সরকারের কাছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সফট-লোন দাবি করেছে।
ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘মূলধন হারিয়ে অনেক স্কুল ভাড়া করা ছোট ঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন। সেজন্যই আমরা ঋণ চেয়েছি।’
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্ডেন অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি-জেনারেল মিজানুর রহমান সরকার বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা ওপর টাকা খরচ করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় লার্নিং রিকভারি প্ল্যান তৈরিতে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে বেসরকারি স্কুলগুলোকে সাহায্য করার কোনো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য সরকারকে অবশ্যই বেসরকারি স্কুলগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। নইলে চূড়ান্ত ক্ষতির শিকার শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরাই হবে বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৬০৮
আপনার মতামত জানানঃ