রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় বিভিন্ন মেডিসিন মার্কেটে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দে গত দু’বছরে অন্তত ৫০ বার অভিযান হলেও বন্ধ হয়নি নকল ওষুধ বেচাকেনা। ৯টি মার্কেটে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই সব মেডিসিন মার্কেটের দোকানির কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ, ওষুধ প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ড্রাগস অ্যান্ড মেডিসিন সমিতির কিছু নেতা নিয়মিত বখরা নিচ্ছেন। ওষুধ ব্যবসায়ীরাই এই অভিযোগ করেছেন।
সূত্র জানায়, মিটফোর্ডে প্রায় ২২টি মেডিসিন মার্কেট রয়েছে। তারমধ্যে সচারাচর যেসব মেডিসিন মার্কেটে ভেজাল, নকল, মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ দেশী-বিদেশী ওষুধ মেলে তা হলো, আলী চেয়ারম্যান মার্কেট, রহিম মার্কেট, সরদার মার্কেট, নৈরাশা মার্কেট, সুরেশ্বরী মার্কেট, নায়না মার্কেট, আমির মার্কেট, রেজা মেডিসিন মার্কেট ও নূপুর মার্কেট। এই মার্কেটগুলোতে দেদার পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ভেজাল, নকল, মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। গত দুই বছরে আনুমানিক ৫০ বার এই মার্কেটগুলোতে অভিযান চালানো হয়। কিছু চিহ্নিত মার্কেটে এই অভিযান চলে। বিভিন্ন মেডিসিন মার্কেটের শতাধিক দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, গত দু’বছরে প্রায় ৫০ বার আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালায় ওই সব মেডিসিন মার্কেটে। তারপরেও থামছে না জীবন বাঁচানোর নামে মরণের দিকে ঠেলে দেয়া ওষুধ বিক্রি। তারা আরো বলেন, আলী চেয়ারম্যান মেডিসিন মার্কেটের প্রায় দোকানে ভেজাল ও নকল ওষুধ বিকি হচ্ছে। তারমধ্যে মিজান মেডিক্যাল, সেবা মেডিক্যাল, মেডিচেইন সার্জিক্যাল, জামাল মেডিসিন, সিমন ড্রাগস ও রিপন মেডিসিন হাউজ বেপরোয়াভাবে ভেজাল, নকল, মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ মেডিসিন পাইকারি বিক্রি করছে। এ ছাড়া রেজা মেডিসিন মার্কেটের ঢাকা ফার্মেসিতে মিটফোর্ড হাসপাতাল ছাড়াও ঢাকা মেডিক্যাল ও মহানগর জেনারেল হাসপাতালের সরকারি ওষুধ বিক্রি করছে। ওই সব হাসপাতালের অসাধু নার্সরা রোগীকে বাইরে থেকে মেডিসিন কিনতে বাধ্য করছে। আর হাসপাতালে রোগীর বরাদ্দকৃত ওষুধ বাইরে বিক্রি করছে। এ ছাড়া রেজা মার্কেটের হাজী কাদের ফার্মেসিতে/দোকানে নকল, ভেজাল, মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ মেডিসিন ছাড়াও সার্জিক্যাল জিনিসপত্র পাইকারি বিক্রি করছে। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অভিযান চালায় ও তাদেরকে জরিমানা করে; কিন্তু তাদের অবৈধ ব্যবসা থামাতে পারছে না। এ দিকে, নায়না মার্কেটের নিচতলায় দাইমী ফার্মাসিতে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে নিয়মিত। এ ছাড়া নূপুর মেডিসিন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় উজ্জ্বল ফার্মেসিতে নকল ও ভেজাল মেডিসিন বিক্রি হচ্ছে। সুরেশ্বরী মার্কেটের সবুজ ড্রাগ হাউজ ও সরদার মার্কেটের রাবেয়া ফার্মেসিসহ শতাধিক দোকানে ভেজাল, নকল, মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ মেডিসিন ও সার্জিক্যালের মালামাল বিক্রি করা হচ্ছে। আলিফ লাম মার্কেটের এক মেডিসিন ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে বলেন, গত দু’বছরে আনুমানিক ৫০ বার অভিযান চালায়। জেল-জরিমানা করলেও ফের ওই সব অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে অসাধুরা। তা ছাড়া নিয়মিত বখরা নিচ্ছে থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ, ওষুধ প্রশাসনের অসাধু কর্তারা। অনেকসময় জব্দ হওয়া মেডিসিন আবারো ঘুরে ফিরে তাদের হাতে চলে আসে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই ব্যবসায়ী জানান, এতে আমরা যারা ফেয়ার ব্যাবসা করি তারা চিন্তিত হচ্ছি। কিভাবে দেশের রোগীরা সুস্থ হবে?
সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ব্যাপক সুনাম থাকা সত্ত্বেও বাজারজুড়ে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি। না জেনে এসব ওষুধ সেবনে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। দেশী-বিদেশী নামী-দামি ওষুধ সেবন করে রোগমুক্ত হওয়া দূরে থাক, উল্টো দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের অগণিত মানুষ। দেশের মোট চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের ১৪৫টির বেশি দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। গত পাঁচ বছরে ওষুধ রফতানি বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কার্যকর সুপারভিশনের অভাবে দেশের হাজার হাজার ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল ও মানহীন ওষুধ অবাধে বিক্রি হচ্ছে। আর এসব ওষুধ পাইকারি দামে মিটফোর্ড থেকে কিনে নিচ্ছে মফস্বলের ফার্মেসিগুলো। টার্গেট করে সঙ্ঘবদ্ধ চক্র মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল ও মানহীন ওষুধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেশি মুনাফার লোভে একশ্রেণীর বিক্রেতা সচেতনভাবেই এ চক্রে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার করে সুস্থতার বদলে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাসোসিয়েশন সমিতির সভাপতি সাদেকুর রহমানকে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে ওই সমিতির পরিচালক জসীম উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, মিটফোর্ডের বিভিন্ন মেডিসিন মার্কেটে ওষুধ প্রশাসন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। করোনাকালেও অভিযান চালানো হয়। এমনকি ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও নিয়মিত তদারকি করছেন। তারপরেও একটি সিন্ডিকেট মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করছে। তবে যারা কিনছেন তারা তো আবার রাজধানী কিংবা মফস্বলের দোকানি। তারা তো দেখেই কিনছেন। ওই সব দোকানিকেও আইনের আওতায় আনা দরকার।
তিনি বলেন, আমাদের সমিতি দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করছে। কোনো অসাধু দোকানির কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার জন্য নয়। এমনকি গত সপ্তাহে র্যাবের দুই ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও এনএসআই ও ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ মেডিসিন-বিষয়ক মিটিং হয়েছে। তবে নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি আগের চেয়ে অনেকটা কমছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আপনার মতামত জানানঃ