তিনি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। অথচ থাকেন আমেরিকায়। সেখানে বসেই চাকরি করছেন, ব্যাংক থেকে নিয়মিত বেতন উত্তোলন করছেন। এমন অভিযোগ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের দক্ষিণ রায়গড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, বর্তমানে ওই শিক্ষিক সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করছেন। প্রধান শিক্ষক দীর্ঘদিন থেকে অনুপস্থিত থাকার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থার অবনতির বিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আজিজুর রহমান খান সিলেট বিভাগীয় শিক্ষা অফিসের উপ-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত নেমে সত্যতা পান বিয়ানীবাজারের শিক্ষা কর্মকর্তা। গত মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিদ্যালয়টিতে সরেজমিনে তদন্ত করেন তিনি।
জেলা ও বিভাগীয় শিক্ষা অফিসে বিদ্যালয়ের সদ্য অনুমোদিত ম্যানেজিং কমিটি লিখিত অভিযোগপত্র ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেসমিন সুলতানা ২০১৩ সালের ২১শে এপ্রিল রায়গড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এক বছর বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকলেও ২০১৫ সালের ১২ই নভেম্বর থেকে ৫ বছর ধরে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন। কিন্তু তিনি নিয়মিত মাসিক বেতনের টাকা উত্তোলন করে আসছেন। ২০১৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর— এই দু’টি তারিখে জেসমিন সুলতানা সোনালী ব্যাংক ঢাকা দক্ষিণ শাখা থেকে মোট ৪ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা রুমান মিয়া বলেন, ‘আমি এসে বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটি সদস্যদের বক্তব্য শুনেছি এবং বিদ্যালয়ের খাতাপত্র দেখেছি। প্রধান শিক্ষক জেসমিন সুলতানা বিদ্যালয়ে যে অনুপস্থিত তার সত্যতা পাওয়া গেছে। শিগগিরই আমি এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট পাঠাবো’।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি আজিজুর রহমান জানিয়েছেন, ‘বিদ্যালয়ের সংরক্ষিত তথ্যমতে প্রধান শিক্ষিক জেসমিন সুলতানা যোগদান করার পর থেকে মাঝে মধ্যে স্কুলে আসতেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, হাজিরা খাতা ও স্লিপের টাকা নিয়ে প্রায় ৫ বছর ধরে লাপাত্তা। শুনেছি সপরিবারে আমেরিকায় আছেন। তবে ২০১৭ সালে এসে ব্যাংক থেকে সরকারি বেতন উত্তোলন করার সময় কয়েকদিন বিদ্যালয়ে এসেছিলেন’।
এর আগে কেন ব্যবস্থা নেয়া হলো না— জবাবে বলেন, ‘কী জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি— সেটি আমার কাছে রহস্যজনক লাগছে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় বিষয়টি নজরে আসেনি। নতুন পরিচালনা কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি নজরে এলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভিযোগ দায়ের করেছি।’
এ ব্যাপারে এ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়তী রাণী চন্দ জানান, ‘প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতির বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে অনেক আগে জানানো হয়েছে। এছাড়াও প্রধান শিক্ষক জেসমিন বেগম আমাকে চাপ প্রয়োগ করে জামিনদার করে ঋণও উত্তোলন করেছিলেন। কিন্তু এখন নিয়মিত কিস্তি না দেয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাকে চাপ দিচ্ছে। আমাকে উনি বিপদে ফেলে দিয়েছেন।
গোলাপগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার দেওয়ান নাজমুল আলম বলেন, ‘জেসমিন সুলতানা কয়েক বছর আগে তৎকালীন শিক্ষা অফিসারের কাছ থেকে তিন মাসের চিকিৎসাজনিত ছুটি নিয়েছিলেন। এখন তিনি কোথায় আছেন আমার জানা নেই’।
এ বিষয়ে জেসমিন সুলতানার ভাই রায়হান আহমেদ বলেন, ‘স্বামীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভিসা পেয়ে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন আপা। বর্তমানে তিনি সেখানে বসবাস করছেন।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকে অনেকটাই হেয় দৃষ্টিতে দেখা হয়। এখানে নামমাত্রেই চাকরি করেন শিক্ষকেরা। কিন্তু তাদের মন পড়ে থাকে অন্যত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই অধিকাংশরা শিক্ষকতার চাকরি নেন। এখানে চাকরি করলে, প্রচলিত আছে যে, নিজের ইচ্ছামাফিক চলা যায়। অর্থাৎ, কিন্ডার্গার্টেনের দৌরাত্মার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে লোকজনের মন উঠে যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও তেমন একটা দেখা যায় না। ফলে শিক্ষকেরা নিজেদের নামমাত্র চাকরি বহাল রেখে অন্যত্র যা ইচ্ছা করে থাকেন।
এক্ষেত্রে সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠদান প্রক্রিয়া উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষকদের বিষয়ে কড়াকড়ি রাখার প্রস্তাব দেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এসবের পাশাপাশি শিক্ষকতাকে কেবলি একটি চাকরি ভাবা থেকে বের হয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৪
আপনার মতামত জানানঃ