মারাত্মক যৌনব্যাধি সিফিলিস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে সংক্রমিত করে আসছে। “কলম্বিয়ান থিওরি” অনুযায়ী, ১৪৯২ সালে কলম্বাসের জাহাজে থাকা নাবিকরা এই রোগটি আমেরিকা থেকে ইউরোপে নিয়ে আসে। এর অল্প কিছুদিন পরেই যখন ১৪৯৫ সালে ফ্রান্স ইতালির নেপলসে আক্রমণ চালায়, তখন প্রথমবারের মত সিফিলিস মহামারী আকারে ছড়িয়ে যায়। অনেকে অবশ্য মনে করেন কলম্বাসের আমেরিকা অভিযান ও ইউরোপে ফিরে আসার আগে থেকেই সেখানে সিফিলিস রোগটির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ১৪৯৫ সাল পর্যন্ত সেটিকে কুষ্ঠরোগ থেকে পৃথক করে নির্ণয় করা যায় নি।
ট্রেপোনমা প্যালিডাম এই রোগের জীবাণু, যা মূলত যৌনসংগমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যৌনসঙ্গমের কারণে যৌন অঙ্গের চামড়ায় সামান্য ক্ষত হলে ঐ স্থানে জীবাণু কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে। কারো কারো বংশে থাকলে তার সন্তানের এ রোগ হতে পারে। শরীরের যে কোন স্থানের ক্ষত জায়গা দিয়েও এই জীবাণু ঢুকে রোগ সৃষ্টি করে। চুম্বনের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। যে সকল পতিতা বা মহিলার মধ্যে এ জীবাণু আছে তাদের সাথে মুক্তভাবে সহবাস করলে এ রোগ হয়। সেবিকা, দাই, দন্ত চিকিৎসকের হাতের আঙ্গুলের দ্বারাও এ রোগ হয়ে থাকে। রক্ত আদান প্রদানের মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। এমনকি আক্রান্ত মায়ের গর্ভের শিশুরও এ রোগ হয়ে থাকে।
সিফিলিসের কারণে মানুষের হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, চোখ ও হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি যথাসময়ে চিকিৎসা না নিলে রোগী মারাও যেতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে সিফিলিসের কথা প্রথম জানা যায় ১৪৯৬ সালে জোসেফ গ্রুনপেক নামের এক ব্যক্তির লেখায়।
তবে এই রোগ নির্মূল করতে যেয়েই গবেষকরা ইতিহাসের অন্যতম বর্বর কাজটি করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সার্ভিসের গবেষকরা মানুষের উপরে একটি জঘন্য প্রকল্প শুরু করে ১৯৩২ সালে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের মধ্যে যৌনবাহিত সিফিলিস রোগের প্রাদুর্ভাব, প্রকৃতি, বিস্তার ও বংশগতির প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে জানা; যাতে এই রোগটি নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা যায়।
সিফিলিস গবেষণার এই কাজটি শুরু হয়েছিল তাসকেজী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই গবেষণায় প্রাথমিকভাবে ৬০০ আফ্রিকান বংশোদ্ভুত আমেরিকান অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এদের মধ্যে ৩৯৯ জন পুরুষ সিফিলিস আক্রান্ত ছিল; যাদের বেশীরভাগই ছিল গরীব, অশিক্ষিত, কৃষক ও দিনমজুর শ্রেণীর। তাদের গবেষণার বিষয়টি জানানো হয়েছিল না। এমনকি ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা গ্রহণেরও সুযোগে দেয়া হয়নি।
এই গবেষণায় অংশ নেয়া পুরুষদের প্ল্যাসিবো হিসেবে স্বাস্থ্যকর্মীরা কেবল এসপিরিন আর মিনারেল সাপ্লিমেন্ট দিতেন। যদিও ১৯৪৭ সালে পেনিসিলিন সিফিলিস রোগের ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, কিন্ত গবেষণা যাতে প্রভাবিত না হয় সেজন্য পাবলিক হেলথ সার্ভিসের গবেষকরা লোকাল ডাক্তারদের নির্দেশ দেন, তাদের সাবজেক্টদের যাতে কোনো প্রকার চিকিৎসা না দেয়া হয়।
উল্টো এই গবেষণায় ইচ্ছাকৃতভাবে সিফিলিস সংক্রমনের অভিযোগও আছে। দূষিত রক্ত পরীক্ষা ও চিকিৎসা, চিকিৎসা কেন্দ্রে বিনামূল্যে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা ও মারা গেলে দাফনের ব্যয়ভার বহন ইত্যাদির লোভ দেখানো হয়েছিল। এমনকি এই গবেষণায় মার্কারী ও আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত যৌগ এ সব মানুষের উপরে প্রয়োগ করা হয়েছিল।
এই গবেষণায় ১৯৭২ সাল নাগাদ ৬০০ জন সাবজেক্টের মাত্র ৭৪ জন বেঁচে ছিল। ৩৯৯ জন পুরুষের মধ্যে ২৮ জন সিফিলিসে এবং ১০০ জন সিফিলিস-জনিত জটিলতায় মৃত্যু হয়েছিল। ৪০ জনের স্ত্রীর মধ্যে সিফিলিস সংক্রমিত হয়েছিল। ১৯ জন শিশু জন্মগতভাবে সিফিলিসে আক্রান্ত ছিল।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই গবেষনার বিষয়ে প্রথম আপত্তি উত্থাপন করেন কিছু বিশেষজ্ঞ। এ সময় এই প্রকল্পকে অপবিজ্ঞান বা কালো বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এই বিষয়টি জনসমক্ষে নিয়ে আসলে প্রকল্পটির ইতি ঘটে।
বিষয়টি আদালতে গড়ালে গবেষণা কর্তৃপক্ষ ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা ও মৃতদের দাফনের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্য হয়। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। এক ভাষণে তিনি বলেন, “পরিশেষে আমেরিকার জনগণের পক্ষ থেকে বলছি, মার্কিন সরকার যা করেছে তা লজ্জাজনক, এবং ফেডারাল সরকার কর্তৃক সঙ্ঘটিত এই বর্ণবাদী গবেষণার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি”।
১৯৭৩ সালে কংগ্রেসে টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে শুনানী হয়। এর ফলশ্রুতিতে পরের বছর এক্সপেরিমেন্টের অংশ করা জীবিত ব্যক্তিদের এবং মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারদের ১০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময় আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ইউএস সরকারের ফান্ডে পরিচালিত সকল রিসার্চ প্রজেক্টে মানুষকে সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন গাইডলাইন আরোপ করা হয়।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সার্ভিসের গবেষকরা এখানেই ক্ষান্ত থাকেননি। এরপর তারা গুয়েতেমালার ৭০০ জনের (যাদের বেশীর ভাগই কয়েদী, মানসিক প্রতিবন্ধী, সেনাসদস্য) উপরে পেনিসিলিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন। এই গবেষণার জন্য কোন সম্মতিপত্র ছাড়াই উদ্দেশ্যমূলকভাবে মানুষকে সিফিলিসে আক্রান্ত করা হয়।
ইচ্ছাকৃত সংক্রমনের বহুবিধ চেষ্টা করা ছাড়াও এ জন্য রোগাক্রান্ত ভাড়াটে যৌনকর্মী ব্যবহার করা হয়। তবে এবার কেউ আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। অবশ্য মার্কিন সেক্রেটারী অফ স্টেট হিলারী ক্লিনটন এবং হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিসেস সেক্রেটারি ক্যাথলিন সেবেলিয়াস দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন বিষয়টি “স্পষ্টতই অনৈতিক”।
ইতিহাসবিদদের মতে, এটা বর্ণবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটা কি সায়েন্টিফিক রেসিজম বা বর্ণবাদ কিনা তা নিয়ে এখনও গবেষণা হচ্ছে। এ বিষয়ে সর্বশেষ অক্সফোর্ড এর জার্নাল অব মেডিকেল হিস্টোরি’র গবেষণাপত্র অনুসারে টাস্কিগির সিফিলিস স্টাডিকে সায়েন্টিক বর্ণবাদের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। বিশ শতকের প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন সিফিলিস জীবাণুর স্নায়ুতন্ত্রে সংক্রমণের (নিউরোসিফিলিস) ক্ষেত্রে বর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং কালোদের ক্ষেত্রে এটা বেশী দেখা যায়। এই পর্যবেক্ষণকে ঐ সময়ের বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণাঙ্গদের আদি প্রকৃতির মস্তিষ্ক গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করতেন। টাস্কিগি স্টাডিতে তাদের এই হাইপোথিসিসকে টেস্ট করার জন্য এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করা হয়। নিউরোসিফিলিস সাধারণত দেখা যায় সিফিলিস সংক্রমণের ১০ থেকে ২০ বছর পর। টাস্কিগির স্টাডি দীর্ঘ মেয়াদী হওয়ায় এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্টের একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব সেই সময় আফ্রিকান আমেরিকান গোষ্ঠীর মধ্যে পড়েছিল। তারা তাদের সরকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ভ্যাকসিন সিস্টেমকে অবিশ্বাস করা শুরু করে। টাস্কিগি স্টাডির মাধ্যমে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চরম অমানবিক বিষয়টি প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে বিশ্ব জুড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার রীতিনীতি ও নৈতিকতায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা ও অতিরিক্ত গণসচেতনতার কারণে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা গণস্বাস্থ্য গবেষণা করা অত্যন্ত দূরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য উন্নত দেশগুলোর রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীগুলো গরীব দেশগুলোর (মূলত আফ্রিকা ও এশিয়ার) গরীব মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ