বেঁচে থেকেও মৃত হবার মত নির্মম পরিহাসের শিকার ৩৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক। এতে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা থেকে। সরকারি তালিকায় মৃত দেখানোর ফলে এসব ব্যক্তি ব্যাংকঋণ, করোনার টিকাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মেটাতেও পারছেন ন।
এনাদের মধ্যে ২১ জন বগুড়ার ধুনট উপজেলার এবং বাকি ১২ জন পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। প্রকৃতপক্ষে এই ৩৩ জন ব্যক্তি বেঁচে থাকলেও সরকারি তথ্যমতে এনারা মৃত।
ধুনট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। তালিকায় নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেইসে ধুনট পৌরসভা এলাকার ২ জন, সদরে ১, মথুরাপুরে ৩, কালেরপাড়ায় ৬, নিমগাছীতে ২, চৌকিবাড়িতে ৫, এলাঙ্গী ও ভান্ডারবাড়িতে ১ জন করে মোট ২১ জনকে মৃত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ২১ জন এখনো জীবিত আছেন।
এদিকে পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ৮ জন, বাউফল উপজেলায় ২ জন, গলাচিপা উপজেলায় ১ জন এবং দুমকি উপজেলায় ১ জন জীবিত থেকেও সরকারী হিসাবে মৃত। সমাজসেবা অধিদপ্তর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে এসব ব্যক্তিদের ভাতা প্রদানের জন্য (এমআইএস) সিস্টেমে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে বিষয়টি নজরে আসে।
২০০৯ সালের জুলাই থেকে মথুরাপুর গ্রামের সুশীলা রানী হালদারের বয়স্ক ভাতা চালু হয়। ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনি ভাতার টাকা উত্তোলন করেছেন। এ অবস্থায় তাকে ভোটার তালিকায় মৃত উল্লেখ করায় বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিল হয়ে যায়।
সুশীলা রানী হালদার বলেন, ‘আমি এখনও জীবিত। তবু ভোটার তালিকায় মৃত দেখানো হয়েছে। বয়স্ক ভাতার কার্ডও বাতিল করা হয়েছে। এখন পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে।
ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের হায়দার আলী বলেন, একটি এনজিওতে গিয়েছিলেন ঋণের জন্য আবেদন করতে। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ভোটার তালিকায় তাকে মৃত দেখানো হয়েছে। পরে তাকে ওই এনজিও থেকে আর ঋণ দেওয়া হয়নি।
ধুনট উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল কাফী জানান, ভোটার তালিকা সংশোধন করা হলে আবারও ভাতার জন্য আবেদন করার সুযোগ থাকবে।
ধুনট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোকাদ্দেছ আলী বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় মাঠপর্যায়ের তথ্য নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেইসে যুক্ত করা হয়। এ সময় ভুলবশত ২১ জীবিত ব্যক্তি মৃতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। গত ২৭ জুন তাদের নাম নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেইসে সংশোধনের জন্য পাঠানো হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করেন তিনি।
‘আমি এখনও জীবিত। তবু ভোটার তালিকায় মৃত দেখানো হয়েছে। বয়স্ক ভাতার কার্ডও বাতিল করা হয়েছে। এখন পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে।
বেঁচে থেকেও ভোটার তালিকায় মৃত মির্জাগঞ্জ উপজেলার আবদুল ছত্তার মিয়া। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ৮৩ বছর। দুই ছেলে, দুই মেয়ে, নাতি-নাতনি ও স্ত্রীসহ মোট ৭ সদস্যের অভাবের সংসার।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে বয়স্ক ভাতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত কোনো জটিলতা ছাড়াই তিনি ভাতা তুলেছেন। কিন্তু ২০২০ সালের জুলাই থেকে তার ভাতা বন্ধ রয়েছে। কারণ ভোটার তালিকার হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী তিনি মৃত। আবদুল ছত্তার মির্জাগঞ্জ উপজেলার মজিদবাড়িয়া ইউনিয়নের মজিদবাড়িয়া গ্রামের মৃত হযরত আলীর ছেলে।
এই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের আরও সাতজন নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে পারলেই তারা আবারও ভাতা উত্তোলন করতে পারবেন। ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নের আমেনা বেগম, সমর্তবান বেগম, সোহরাব গোলদার, মাধবখালী ইউনিয়ন হাজেরা বেগম, কাকড়াবুনিয়া ইউনিয়নের মো. করিম হাওলাদার, মো. খলিল হাওলাদার, মজিদবাড়িয়া আম্বিয়া বেগম ও আবদুল ছত্তার আবেদন করেছেন।
পটুয়াখালী সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শীলা রানী এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, বিগত বছরগুলোতে ম্যানুয়ালি বয়স্ক ভাতা দেওয়া হতো। তবে সরকার এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) এর মাধ্যমে বয়স্ক ভাতা প্রদানের কার্যক্রম শুরু করার পর আমরা যখন এসব ভাতাভোগীদের তথ্য ডাটাবেজে ইনপুট দিচ্ছি তখন নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেজ বলছে এসব ব্যক্তিরা মৃত। সে কারণে তাদের তথ্য দেওয়া যাচ্ছে না। তাই আপাতত ভাতা বন্ধ রয়েছে। তবে এরা যাতে দ্রুত নির্বাচন অফিস থেকে তাদের তথ্য হালনাগাদ করতে সেজন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসে আমরা যোগাযোগ করে দিয়েছি।
পটুয়াখালী জেলা সিনিয়র নির্বাচন অফিসার খান আবি শাহানুর খান বলেন, হালনাগাদ ভোটার তালিকায় কতজনের তথ্যে এমন বিভ্রান্তি রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, তবে কোনো উপজেলায় এমনটি ঘটলে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তথ্য উপাত্ত নিয়ে আবেদন করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন নাগরিকের জন্য সরকারি তালিকায় নাম থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কোনো ঝামেলায় পুলিশের সাহায্য থেকে শুরু করে যেকোনো সরকারি-বেসরকারি সুযোগ সুবিধা নিতে এর বিকল্প নেই। সরকারি তথ্য সংগ্রহের সময় কর্মকর্তাদের আরও সতর্ক হওয়া এবং সুষ্ঠু নজরদারিতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ