আফগানিস্তানের পর এবার সিরিয়ার তিনটি ঘাঁটি থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করেছে ওয়াশিংটন। ইরানের আরবি ভাষার স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আল-আলম এই খবর প্রকাশ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার এই পিছু হটা, মূলত তাদের সাম্রাজ্যবাদ নীতির ভেঙে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সন্ত্রাস ছড়িয়ে, সেটা দমনের নামে বিভিন্ন দেশে বৈধ বা অবৈধভাবে অবস্থান করে নয়া ঔপনিবেশবাদের যে খেলা আমেরিকা দীর্ঘদিন খেলে এসেছে, তা শেষের মুখে।
সূত্র মতে, যে তিনটি ঘাঁটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত, যার অবস্থান ছিল সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় দেইর আজ-জাওয়ার প্রদেশের আল ওমর তেল ক্ষেত্রের কাছে। বাকি দুটি ঘাঁটির অবস্থান ছিল সিরিয়ার দূরবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হাসাকা প্রদেশের সীমান্তবর্তী কামিশলি এলাকায়।
এদিকে, সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় দেইর আজ-জোর প্রদেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে রকেট হামলা হয়েছে। এই ঘাঁটিটি কুনিকো গ্যাসক্ষেত্রের কাছে অবস্থিত। সিরিয়ার আল-আখবারিয়া টিভি চ্যানেল জানিয়েছে, মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে অন্তত দু’টি রকেট আঘাত হেনেছে।
আরও পড়ুন: সিরিয়া হামলা দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের যুদ্ধে হাতেখড়ি
যদিও গত মাসের মাঝামাঝিই যুদ্ধবিধস্ত সিরিয়ায় নতুন করে সেনা মোতায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। রুশ বাহিনীর সঙ্গে একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি ছয়টি অস্ত্র সজ্জিত ট্যাংক এবং শতাধিক সেনা পাঠিয়েছিল বলে জানায় বিবিসি।
গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চলে মার্কিন এবং রুশ বাহিনী নিয়মিত টহল দেয়। এ বছর দুই বাহিনী বেশ কয়েকবার মুখোমুখি হওয়ায় ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বেড়েছিল।
জুলাই মাসের শেষ দিকে মার্কিন সেনাদের একটি দল রাশিয়ার একটি সাঁজোয়া যানের মুখোমুখি হয়ে গেলে লড়াইয়ে সাত মার্কিন সেনা আহত হয়। এ ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া সরকার পরষ্পরকে দায়ী করে।
সিরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চলে গত মাসেও প্রায় পাঁচশ’ মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল। তারা সেখানে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কুর্দি বাহিনীকে সহায়তা করত। অন্যদিকে রুশ বাহিনী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের হয়ে লড়াই করে।
২০১১ সালে সিরিয়ায় বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব শুরু করার পর উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকা ও তার মিত্র কয়েকটি দেশ সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালায়।
আমেরিকা সামরিক জোট গঠন করলেও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তাদের কার্যকর কোনো হামলা চালাতে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাশিয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে।
রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহ-এর সহায়তায় সিরিয়ার সেনারা ধীরে ধীরে দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে সক্ষম হলেও আমেরিকা দেশটিতে অবৈধভাবে দামেস্ক সরকারের বিনা অনুমতিতে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে।
গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহেও সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক। একইসঙ্গে সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে একটি মার্কিন কোম্পানির স্বাক্ষরিত তেল চুক্তির বিষয়েও উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে।
ইরান, রাশিয়া ও তুরস্কের যৌথ বিবৃতিতে সিরিয়ার তেল বিক্রির অর্থকে সে দেশের জনগণের সম্পদ হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়, দেশটির তেল সম্পদ কুক্ষিগত করার যে পদক্ষেপ মার্কিন কোম্পানিগুলো নিয়েছে তা নিন্দনীয়।
এদিকে, মার্কিন ঘাঁটি সিরিয়ার তেলসম্পদ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত বলে বাশার আল-আসাদের সরকার সুস্পষ্ট অভিযোগ করে আসছে।
সম্প্রতি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বলেছেন, মার্কিন সরকার নিজের অশুভ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে এবং সিরিয়ায় জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
আরও পড়ুন: বিচারক ও হজে নিরাপত্তাকর্মীর পর সৌদিতে এবার প্রশিক্ষণ নিল প্রথম নারী সেনা দল
প্রেসিডেন্ট আসাদ আরও বলেন, সম্প্রতি আমেরিকা দামেস্কের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে, তার উদ্দেশ্য সন্ত্রাসীদের সমর্থন করা।
সিরিয়ার সরকার বারবারই বলে আসছে, সেদেশের ভূখণ্ডে মার্কিন সেনার উপস্থিতির কোনো বৈধতা নেই। অবিলম্বে সে দেশ ত্যাগের জন্য মার্কিন সেনাদের প্রতি দামেস্ক আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু তারা সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সেখানে অবস্থান করছে। অবশ্য বাস্তবে তারা সন্ত্রাসীদেরকেই নানা ধরণের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলে সিরিয়ার সরকার পক্ষ মনে করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিরিয়া সরকারের অনুমতি বা জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই দেশটিতে অবৈধভাবে মার্কিন সেনা মোতায়েন কতটা যুক্তিসঙ্গত তা খুঁটিয়ে দেখার সময় এসেছে। সেখান থেকে তেল ও গমসহ বিভিন্ন পণ্য চুরি করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও পর্যালোচনা করা দরকার। সিরিয়ায় ২০১১ সাল থেকে যে সহিংসতা চলছে, তার পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে আমেরিকা, দখলদার ইসরায়েল এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দেশের।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ