ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরী করায় বেশ কিছুদিন যাবৎ শিথীলতা আনতে শুরু করেছে সৌদি আরব। তারই ধারাবাহিকতায় এবার প্রথমবারের মত সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ শেষ করলো সৌদি নারীরা। বিগত হজে প্রথমবার নারী দেহরক্ষী মোতায়ন করা হয়েছিলো। এর আগে সৌদি নারীরা বিচারকের আসনে বসার অনুমতিও পেয়েছে। আগে সৌদিতে নারীরা পুরুষের অভিভাবকত্ব ছাড়া হজ করতে পারতেন না, সম্প্রতি সৌদি এরও পরিবর্তন এনেছে। নারীরা এখন ড্রাইভিংয়ের অনুমতিসহ একা থাকারও অনুমতি পেয়েছেন। ‘ভিশন ২০৩০’ নামের এই সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সৌদি নারীদের জীবন বদলে দিতে বেশ কিছু সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন যুবরাজ বিন সালমান।
সৌদিতে নারী সেনাদের প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটরা তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। গতকাল বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) তারা ১৪ সপ্তাহের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। সৌদি সেনাপ্রধান জেনারেল ফায়াদ আল-রুয়াইলি বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে নারী ক্যাডেটদের মধ্যে সনদ বিতরণ করেন। খবর সৌদি গেজেটের।
এ বছরের ৩০ মে থেকে তারা ওই প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নেন। সেনাবাহিনীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল আদেল আল-বালাবি বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সফলভাবে নারীরা তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন।
প্রশিক্ষিত এসব নারী সেনা সদস্যদের প্রয়োজনীয় স্থানে নিযুক্ত করা হবে। নারী সেনাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার সার্জেন্ট সুলাইমান আল-মালিকি ছাড়াও সৌদি সেনাবাহিনীর শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
হজে নারী দেহরক্ষী
বিগতবারই প্রথম হাজিদের নিরাপত্তায় মক্কা ও মদিনায় নারী সেনাদের নিয়োগ দিয়েছিল সৌদি সরকার। গত এপ্রিল থেকে দেশটিতে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন নারী সেনারা। সৌদি নারী মোনা কাজ করেন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীতে। বিগত হজের সময় তিনি হাজিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন। কাজ করেছেন পবিত্র শহর মক্কায়। মোনা একাই নন, হজে হাজিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন সৌদি আরবের নারী সেনাদের একটি দল। খাকি রঙের সামরিক পোশাকের সঙ্গে লম্বা ঝুলের জ্যাকেট, ঢিলেঢালা ট্রাউজার পরে পালা করে হাজিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন নারী সেনারা।
মোনা বলেন, ‘আমার বাবাও সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তিনি মারা গেছেন। সেনাসদস্য হতে তিনি আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পবিত্র এই জায়গার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছি। হাজিদের জন্য কাজ করতে পারাটা খুবই সম্মানের।’
মোনার মতো হাজিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন সৌদি আরবের আরেক নারী সেনা সামার। তিনি পবিত্র কাবাঘরের পাশে দায়িত্বে ছিলেন। মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এরপর যোগ দিয়েছেন সেনাবাহিনীতে। সামার বলেন, ‘সেনাসদস্য হতে পরিবারের সদস্যরা আমাকে ভীষণ উৎসাহ জুগিয়েছে।’
একসময় সৌদি আরবের সমাজ ছিল বেশ রক্ষণশীল। সেই অবস্থান থেকে দেশটিকে ধীরে ধীরে বের করে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তার হাত ধরে দেশটিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম চলছে। এর লক্ষ্য সামাজিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ।
মূলত এই সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সৌদি সেনাবাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। পবিত্র হজের সময় হাজিদের নিরাপত্তার দায়িত্বও নারী সেনাদের হাতে দেওয়া হয়েছে।
বিচারকের আসনে সৌদি নারী
মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকে নারীদের ওপর থেকে একের পর এক বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হচ্ছে। নারীরা এখন মাঠে বসে কনসার্ট ও খেলা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এ তালিকায় যোগ হয়েছে নারীদের বিচারক হবার সুযোগও। প্রথমবারের মতো বিচারকের আসনে একজন নারীকে বসার স্বাধীনতা দিচ্ছে ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরব।
সৌদি মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি হিন্দ আল-জাহিদ এমন তথ্য জানান। তিনি বলেন, এ দেশে শীঘ্রই বিচারকের আসনে বসতে যাচ্ছেন নারীরা। আর তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আল-আরাবিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। নারীর অধিকার অর্জনে সৌদি অগ্রগতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জানিয়ে তিনি জানান, সৌদি শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। বর্তমানে এই অংশগ্রহণের হার ৩১ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে সৌদি নারীদের অংশগ্রহণ ৩৯ থেকে ৪১ শতাংশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে নারীদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
সরকারি চাকরিতে সৌদি নারীদের অংশগ্রহণ ৩৯ থেকে ৪১ শতাংশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে নারীদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার কর্মসূচি ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বর্তমানে সৌদি নারীরা বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে সৌদি নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে মোট জনশক্তির এক-তৃতীয়াংশ করতে চায় দেশটি।
সৌদির রাজধানী রিয়াদে এখন বিপুল সংখ্যক ছাত্রীকে স্কুলে যেতে দেখা যায়, ৬৫ বছর আগে যা ভাবাই যেত না। সৌদির মেয়েদের প্রথম স্কুল দার আল হানান। আর রিয়াদ কলেজ অব এডুকেশন সৌদি নারীদের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৭০ সালে চালু হয়।
পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হজ ও একা থাকা অনুমতি
সৌদি নারীদের পুরুষ অভিভাবক অর্থাৎ কারো স্ত্রী, মা, বোন ইত্যাদি পরিচয় নিয়েই তবে হজের জন্য নিবন্ধন করতে হতো। তবে বিগত হজে পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই হজের জন্য নিবন্ধিত হতে পেরেছেন দেশটির নারীরা। অর্থাৎ মাহরাম ছাড়াই নারীরা এখন থেকে হজ করতে পারবেন। সৌদি হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোতে এ খবর জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই হজের জন্য নারীদের নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে সৌদি আরব। অর্থাৎ মাহরাম (পুরুষ অভিভাবক) ছাড়াই নারীরা এখন থেকে হজ করতে পারবেন।
মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, কোনো মাহরামের (পুরুষ আত্মীয়) সাহচর্যের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই নারীরা এখন থেকে হজের আবেদন করতে পারবেন।
সম্প্রতি সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ দেশটির শরিয়াহ আইনের আর্টিকেল ১৬৯ এর বি ধারাটি বাতিল করে। যেখানে লেখা ছিল বিবাহিত, অবিবাহিত ও সেপারেটেড নারীদের তাদের পুরুষ অভিভাবকের অধীনস্থ থাকতে হবে। নতুন আইন অনুযায়ী যেকোন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর আলাদা থাকার অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে পুরুষ অভিভাবক তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের অভিযোগ করতে পারবেন না। শুধু তখনই অভিযোগ করতে পারবেন যখন উক্ত নারী কোন অপরাধ করবেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে প্রথমবারের মত নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয় সৌদি আরব সরকার। এরমধ্য দিয়ে দেশটিতে নতুন যুগের শুরু হয়েছিলো। এরপর একে একে সৌদি থেকে নানা প্রতিবন্ধকতা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে যা সুফল বয়ে আনবেন বলে বিশ্বাস সংশ্লিষ্টদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৮
আপনার মতামত জানানঃ