গ্রাম বাংলায় স্থানীয় চেয়ারম্যানদের নামের পাশে একসময় ‘গমচোর’ টিনচোর’ চালচোর’ ‘কাঠচোর’ ‘মাটিচোর’ ইত্যাদি বিভিন্ন ট্যাগ জুড়ে দিতো। ফলে আসল নামে চেয়ারম্যান পরিচিত না হলেও স্থানীয় পর্যায়ে গমচোর চেয়ারম্যান, চালচোর চেয়ারম্যান ইত্যাদি নামে পরিচিত হতো। এখন যুগ পাল্টেছে, পৃথিবী পাল্টেছে, পাল্টে যাচ্ছে কতোকিছু। কিন্তু পাল্টাননি চেয়ারম্যানরা। এখনো তাদেরকে ঐসব নামেই স্থানীয় পর্যায়ে চেনা হয়। কেননা, তারা তাদের কর্মকাণ্ড এখনো আগের মতোই ঐতিহ্য মনে করে ধরে রেখেছেন। ফলে প্রায় প্রতিদিনই চেয়ারম্যানদের নামে বিভিন্ন কুকীর্তির সংবাদ আসে মিডিয়াতে। সম্প্রতি জাল কাগজপত্র তৈরি করে সরকারি চাল আত্মসাতের অভিযোগে গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৬ জন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া চেয়ারম্যানসহ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকতা, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, কাউন্সিলরসহ মোট ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, রংপুরের সহকারী পরিচালক মো. হোসাইন শরীফ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার আসামিরা হলেন— গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহরিুল ইসলাম, ১নং কামদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাহেদ হোসেন চৌধুরী, ২নং কাটাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম (রফিক), ৩নং শাখাহার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তাহাজুল ইসলাম, ৪নং রাজাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ সরকার, ৫নং সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আলম, ৬ নং দরবস্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ. র. ম. শরিফুল ইসলাম জজ, ৭নং তালুককানুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতিবুর রহমান আতিক, ৮নং নাকাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদরে প্রধান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আকতারা বেগম, ১০ নং রাখালবুরুজ ইউনিয়ন পরিষদের শাহদাত হোসেন, ১১নং ফুলবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মোল্লা, ১২ নং গুমানীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরী মোস্তফা জগলুল রশদি রিপন, ১৩নং কামারদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরফিুল ইসলাম রতন, ১৪নং কোচাশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন, ১৫ নং শবিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেকেন্দার আলী মণ্ডল, ১৬ নং মহিমাগঞ্জ ইউনিয়ন পরষিদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ প্রধান, ১৭ নং শালমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমি হোসেন শামীম ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর গোলাপী বেগম।
দুদক সূত্র জানায়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ধর্মীয় সভার অনুকূলে জিআর বরাদ্দকৃত ৫ হাজার ৮২ মেট্রিকটন সরকারি চাল জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নের জাল কাগজপত্র তৈরি করে সরকারি চাল তুলে কালোবাজারে বিক্রি করে। যার তৎকালীন বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২২ কোটি টাকা।
দুদক সূত্র জানায়, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলা দায়েরের আগে বিষয়টি দুদকের পক্ষ থেকে প্রাথমিক অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর কমিশনের এক বৈঠকে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অসহায় দুঃস্থদের জন্য সরকার বরাদ্দ দিলেও তাদের হাতে পৌছায় সামান্যই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য তারা বঞ্চিত হন। এমপি মন্ত্রীদের হাত বদল হয়ে শেষে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারসহ লোকাল নেতাকর্মীদের হয়ে যেতে যেতে সরকারি সহায়তার অবশিষ্ট আর কিছু থাকে না। নামেই কেবল সরকারি সহায়তা, প্রকৃতপক্ষে যাদের জন্য বরাদ্দ হয় তারা বলতে গেলে কড়ি পয়সাও পায় না। এবিষয়ে সরকারের প্রশ্রয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিরব ভূমিকা এবং প্রশাসনের নজরদারির অভাবকে দায়ি করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, স্থানীয় চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে প্রায়ই বিভিন্ন রকমের অভিযোগ আসে। তারা জনপ্রতিনিধি হয়েও বিভিন্ন দুর্নীতি, সরকারি অনুদান চুরি, জোর করে জমি দখলসহ আরো বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েন যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। জনগণের পাশে থাকার জন্য নির্বাচিত হলেও তারা আদতে নিজেদের ফায়দা লুটার জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা, বরখাস্ত ইত্যাদি চলমান থাকলেও থামানো যাচ্ছে না তাদের। সম্প্রতি এসব যেন বেড়েই চলছে। এবিষয়ে সরকারের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং প্রশাসনের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে দোষীদের কেবল বরখাস্তই নয়, উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হওয়ার সুবাধে আ’লীগের ছত্রছায়ায় তারা ব্যাপক হারে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা মনে করেন, নিজেদের ভাণ্ডার ভরে তোলার জন্যই যেন তারা জেলা পরিষদের সাইনবোর্ডটি ব্যবহার করছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা পরিষদের চিত্রটা এমনি বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা জানান, দেশের অধিকাংশ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় প্রভাবশালী সরকার দলীয় নেতা। তাদের বিভিন্ন দুর্নীতি আর অনিয়মের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই কেউ আওয়াজ তুলতে সাহস পান না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ