রক্ত ক্রসম্যাচ না করেই এক সদ্য প্রসূতি মাকে ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ছটফট করছেন ওই প্রসূতি নারী। ঘটনাটি শনিবার ২৮ আগস্ট ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঘটে বলে স্বজনদের দাবি।
বর্তমানে প্রসূতি আঁখি আক্তার ও নবজাতক হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। আঁখি আক্তার ফরিদপুরের সালথা উপজেলার খারদিয়া গ্রামের আল আমীন শেখের স্ত্রী।
ভুক্তভোগীর স্বজনরা জানান, ২৭ আগস্ট সন্তান প্রসবের পর আঁখি আক্তারের রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়। ওই দিনই তাকে ভর্তি করা হয় ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ সময় দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। পরামর্শ অনুযায়ী দুই রক্তদাতাকে তারা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আঁখির রক্তের গ্রুপ ও ক্রস ম্যাচিং করার আগে প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ মো. নুরুল আমীন পরীক্ষা করে জানান, আঁখির রক্তের গ্রুপ ‘এ’ পজিটিভ। কিন্তু স্বজনরা জানান তার রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ।
রক্তের গ্রুপ ভিন্ন আসার বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে ২৭ আগস্ট হাসপাতাল থেকে দেওয়া রক্তের চাহিদাপত্রে দেখা যায়, সেখানে আঁখির রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ আসে। পরে সেটা কেটে এ পজিটিভ লেখা হয়। এরপর ৩০ আগস্ট দেওয়া রক্তের আরেকটি চাহিদাপত্রে ‘বি’ পজিটিভ লেখা হয়। এছাড়া ১০ মার্চ আঁখি আক্তার বোয়ালমারী সূর্যের হাসি ক্লিনিকে রক্ত পরীক্ষা করান। সেখানেও তার রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ বলা হয়। অথচ আঁখিকে ‘এ’ পজিটিভ রক্ত দেওয়া হয় বলে অভিযোগ স্বজনদের।
ভুক্তভোগীর স্বামী আল আমীন শেখ বলেন, আমার স্ত্রীকে ‘বি’ পজিটিভ রক্ত না দিয়ে এ পজিটিভ রক্ত দেওয়া হয়েছে। একে তো অপারেশনের রোগী আবার ভুল রক্ত শরীরে দেওয়ায় সে এখন পাগল প্রায়। বিছানায় ছটফট করছে। আমরা রক্ত দেওয়ার আগে বারবার বলেছি তার রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ। কিন্তু নুরুল আমীন সাহেব আমাদের কথা কর্ণপাত করেননি। তিনি পরীক্ষা করে ‘এ’ পজিটিভ রক্তের কথা বলেছেন এবং আমাদের কাগজপত্রও দিয়েছেন। এখন আমার স্ত্রী ও নবজাতক ছেলের অবস্থা খুবই খারাপ। আমি এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, রোগীর স্বজনদের পক্ষ থেকে এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রক্তের গ্রুপ নিয়ে এমন অসতর্কতা অবশ্যই তদন্তের আওতায় আসা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা এবং তাদের চোখে ব্লাড ব্যাংক নিয়েও বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। সেগুরো হলো-
দেশে অনুমতিপ্রাপ্ত ব্ল্যাড ব্যাংক মাত্র ৫৪টি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. মোমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে এখন পর্যন্ত সরকারি অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারী ব্লাড ব্যাংক রয়েছে মাত্র ৫৪টি। এর মধ্যে ঢাকায় প্রায় সবগুলো। ঢাকার বাইরে সারাদেশে নিবন্ধিত ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ৫/৭টি। অথচ ঢাকা শহরেই অলিগলিতে অনেক ব্লাড ব্যাংক বছরের পর পর বছর রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে এর সংখ্যা প্রচুর। অবৈধ এসব ব্লাড ব্যাংকের অধিকাংশেই প্রশিক্ষিত ডাক্তার কিংবা টেকনিশিয়ান নেই।
ব্লাড ব্যাংকের মনিটরিং হচ্ছে না
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র (ব্লম্লাড ব্যাংক)। দেশে যদি মাত্র ৫৪টি নিবন্ধিত ব্লাড ব্যাংক থাকলে সারাদেশে পরিচালিত অন্যান্য রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলো অবৈধ। লাইসেন্স করা ব্লাড ব্যাংকগুলোর নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছেনা। জানা গেছে, বেশিরভাগ সময় মন্ত্রণালয়ে মিটিং থাকে বিধায় মনিটরিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্টরা পর্যাপ্ত সময় পান না।
সারা দেশে কতগুলো ব্লাড ব্যাংক রয়েছে এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. মো. মোমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, কতগুলো অবৈধ ব্লাড ব্যাংক রয়েছে তা বলতে পারব না। কেননা বাড়ী বাড়ী গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার মত লোকবল তাদের নেই। এ কাজটা হয়তো সিটি কর্পোরেশন করতে পারে। তিনি জানালেন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে সংবাদ পেলে অভিযান হয় এবং তখন তারা ধরা খায়। তিনি আরো জানালেন, পর্যাপ্ত যানবাহন ও লোকবলের অভাবে মনিটরিং করা সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না।
বড় হাসপাতালগুলোতেও ব্লাড ব্যাংক নেই
ঢাকা শহরের বড় হাসপাতালগুলোর অনেকগুলোতেই ব্লাড ব্যাংক নেই। অথচ সেখানে ডেঙ্গু, নিউরোসার্জারির মতো রোগেরও চিকিৎসা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে যা পাওয়া গেছে, তা হলো ব্লাড ব্যাংক করার বিষয়টিতে লাভবান হওয়ার মতো বিষয় নেই বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এতে তেমন আগ্রহী নয়। অথচ আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট), সিটি স্ক্যানের মতো ব্যয়বহুল খাতে তারা বিনিয়োগ করছে।
কিন্তু একজন ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট দরকার হলে তাকে কোথায় পাঠাবে কিংবা কীভাবে তা ম্যানেজ করবে, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে। কেননা প্লাটিলেট তৈরি হতে সময় লাগে ৬-৭ ঘণ্টা। প্লাটিলেট অবশ্যই পাঁচ দিনের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে, সেটাও মানা হচ্ছে না। সংগ্রহ করা রক্ত ২ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কতদিন রাখা যায়, তা নির্ভর করে তাপমাত্রা ও ব্যবহৃত কেমিক্যালের ওপর। তবে যে কোনো রক্ত ফ্রিজ থেকে সরবরাহের আধাঘণ্টার মধ্যে রোগীর দেহে প্রয়োগ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না।
আইন মানছে না বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলো
বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত ব্লাড ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকার ২০০২ সালে ‘নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন আইন-২০০২’ নামে একটি আইন পাস করে। কিন্তু এ আইন মানছে না বেসরকারি এবং অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলো। অসংখ্য অনুমোদনহীন ব্লাড ব্যাংক অনিয়ন্ত্রিত ও বিপজ্জনক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ রক্ত বলতে বোঝায়, যে রক্ত ১২ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ট্রান্সফিউশনের পর তা যত তাড়াতাড়ি দেয়া যায় তত ভালো। কয়েকদিন জমা করা রক্তের চেয়ে ফ্রেশ ব্লাড অবশ্যই ভালো।
আবার স্ক্রিনিং কিটস্ সঙ্কটের কারণেও দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর ব্লাড ব্যাংকগুলোতে মাঝে মাঝেই স্ক্রিনিং ছাড়াই রক্ত সঞ্চালন হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গুটিকয়েক হাসপাতালে সিফিলিস ও হেপাটাইটিস-বি টেস্ট করা হলেও অন্যান্য পরীক্ষা করানো হয় না।
পরীক্ষা হয় না বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলোতে
সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার নেই। এসব ব্লাড ব্যাংকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত পাঁচটি ঘাতক ব্যাধির পরীক্ষা করা হয় না এবং তারা যথেষ্ট স্টেরিলিটি (সংক্রমণ রোধকারী ব্যবস্থা) মেনে চলে না। তারা রক্তদাতা নির্বাচনের পূর্বশর্তও মানেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অসুস্থ, নেশাসক্ত কিংবা পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত কিনে নেয়া হয়। এখানে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নেই পোস্ট ডোনেশন রুম, পরিবেশও নোংরা। সরবরাহ করা রক্ত দেখতে অনেকটা ঘোলা পানির মতো। এসব ব্লাড ব্যাংক প্রদত্ত রক্তে সঠিক মাত্রায় রক্তের উপাদান এবং পর্যাপ্ত সেল থাকে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ডাক্তার নামে যারা থাকেন, তারা ক্রস ম্যাচিংয়ের ফরমে স্বাক্ষর করে রাখেন আগে থেকেই। মোটকথা, স্ক্রিনিং ও ক্রসম্যাচিং ছাড়াই রক্ত দেয়া হচ্ছে এসব ব্লাড ব্যাংকে।
রক্ত যে কোনো প্রাণীর শরীরের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ বিষয়ে স্বাস্থকর্মীদের সতর্কতা খুবই প্রয়োজনীয়। কেবল রক্ত নিয়ে সতর্কতা এবং নিরাপদ রক্ত নিশ্চিত করতে পারলেই অনেক রোগীর প্রাণ বেঁচে যেতো। রক্তের অভাবে এবং রক্তের অসঙ্গতির জন্য ভুক্তভোগীর সংখ্যাও দেশে কম নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৪৩৮
আপনার মতামত জানানঃ