আজকাল বিশ্বের খুব কম জায়গায় রাতের আকাশের নির্মল রূপ দেখা যায়। আলোর দূষণের কারণে সেই সুযোগ কমেই চলেছে। এই আলোক দূষণের কারণে পোকামাকড়ের সংখ্যা ‘উদ্বেগজনকভাবে’ কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীদের করা একটি গবেষণার বরাতে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়কবাতির কৃত্রিম আলো নিশাচর পতঙ্গের স্বাভাবিক আচরণে বাঁধা দেয় এবং শুঁয়োপোকার সংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে দেয়।
বিজ্ঞানীদের ভাষ্য, আলোর এ দূষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে আধুনিক এলইডি সড়কবাতিগুলো।
নানা সময়েই বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন, আবাসস্থল হ্রাস এবং কীটনাশকের কারণে পোকামাকড়ের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
এই ফ্যাক্টরগুলো ছাড়াও বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহার পোকার সংখ্যা কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি চলক হিসেবে কাজ করে। তবে এটার পরিমাণ ঠিক কতোটুকু সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
‘সায়েন্স অ্যাডভান্সে’ প্রকাশিত এই গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, আলোক দূষণের কারণে পোকামাকড়ের সংখ্যার উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ায় খাদ্যের জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল পাখি, বন্যপ্রাণিসহ বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য প্রাণিরাও বিপাকে পড়ে।
গবেষকরা বলছেন, আলোর কারণে যেভাবে পোকামাকড় কমছে ভবিষ্যতে তা পাখি আর অন্য বন্যপ্রাণী যারা খাবারের ওপর ক্যাটারপিলারের ওপর নির্ভরশীল তাদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। যদিও এটা পরিষ্কার না, আলোর দূষণ কতটুকু প্রভাব ফেলছে, তবে আলোর দূষণ যে পোকামাকড় কমাচ্ছে এটা প্রমাণিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পোকামাকড় সমস্যায় আছে মানে পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানে সম্যসা তৈরি হচ্ছে, স্বাভাবিকতা ব্যাহত হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাস্তার এলইডি লাইটগুলোর কারণে ডিম পাড়ে না, কিংবা এমন জায়গায় পাড়ে যেখান থেকে বাদুড় কিংবা অন্য কোনো পাখি খেয়ে ফেলে। তবে ক্যাটারপিলার আবার এলইডি লাইটের নিচেই জন্মায়। স্বাভাবিক ডিম পাড়ার জায়গা পরিবর্তন হলে ক্যাটারপিলারের ডিম পাড়ার ক্ষমতা কমে যায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী হারাল্ড বার্ডেনহাগেন বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রাতের আলোর নানারকম নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। একদিকে মানুষের স্বাস্থ্য, অন্যদিকে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। তা ছাড়া রাতের কৃত্রিম আলোর ছটা আকাশের গ্রহ-তারাকেও ম্লান করে দেয়।
অনেক প্রাণীর ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। পাখিরা দিকনির্ণয় করতে না পেরে আলোকিত বাড়ি-ঘরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মরে যাচ্ছে। কচ্ছপরা চাঁদের আলো দেখে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু শহরের আলো তাদের মনে বিভ্রান্তি আনে। তাই তারা অনেক সময় সমুদ্রের বদলে উল্টো দিকে চলতে থাকে। ত্বক শুকিয়ে যায়, তাদের মৃত্যু ঘটে। তবে এসব কৃত্রিম আলোতে শুধু জন্তু-জানোয়ার নয়, মানুষেরও ক্ষতি হয়।
পাখিরা দিকনির্ণয় করতে না পেরে আলোকিত বাড়ি-ঘরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মরে যাচ্ছে। কচ্ছপরা চাঁদের আলো দেখে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু শহরের আলো তাদের মনে বিভ্রান্তি আনে। তাই তারা অনেক সময় সমুদ্রের বদলে উল্টো দিকে চলতে থাকে। ত্বক শুকিয়ে যায়, তাদের মৃত্যু ঘটে। তবে এসব কৃত্রিম আলোতে শুধু জন্তু-জানোয়ার নয়, মানুষেরও ক্ষতি হয়।
হারাল্ড বার্ডেনহাগেন বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরেও এর প্রভাব পড়ে, কারণ বডি-ক্লক ওলটপালট হয়ে যায়। রাতে কৃত্রিম আলোর কারণে স্তন ও প্রস্ট্রেট ক্যানসারের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।
২০১৯ সালে পোকামাকড়ের ওপর করা একটি গবেষণা বলছে, ৪০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার পথে আছে। সারাবিশ্বে আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে এসব পোকামাকড়ের সংখ্যা। মৌমাছি, পিপড়া আর গুবরে পোকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণি, পাখি আর সরীসৃপ প্রাণীর চেয়ে ৮ গুণ দ্রুতগতিতে।
অন্যদিকে, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তেলাপোকা, মাছি, পঙ্গপালতো ভয়াবহভাবে বাড়ছে। পুরো পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানকে ভেঙে দিতে পারে এই পোকামাকড়ের সংকট। পোকামাকড় পাখি, সরীসৃপ প্রাণী, বাদুড়ের মতো পরিবেশের উপকারী প্রাণীর জন্য খাবার সরবরাহ করে। আবার গাছও পরাগায়ণের জন্য পোকামাকড়ের ওপরই নির্ভরশীল।
যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজির প্রধান গবেষক ডগলাস বয়েস বলেন, আমরা এখন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী যে আলোক দূষণ মারাত্মক। কিন্তু আমরা যদি সবকিছু বিবেচনা করতে যাই, তখন এটি অতোটা প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে হবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি পোকামাকড় এ কারণে সমস্যায় পড়ছে। এই মনে করার পেছনে যথেষ্ট প্রমাণও আমাদের কাছে আছে। পোকামাকড়ের উপর এই নেতিবাচক প্রভাবগুলো কমাতে আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।
গবেষকরা মনে করেন, রাস্তার আলো নিশাচর পতঙ্গকে তাদের ডিম পাড়া থেকে বিরত রাখতে পারে।
তারা মনে করেন, যেসব শুঁয়োপোকা স্ট্রিটলাইটের নিচে বিশেষ করে এলইডি লাইটের নিচে জন্মায় সেগুলো তাদের খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন করে ফেলে।
গবেষণাটিতে এ বিষয়ে কিছু সমাধানের পথও বলে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সেগুলোর কোনোটিই মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে আপোস করে নয়। এর মধ্যে রয়েছে রাতের প্রথম প্রহরে স্ট্রিটলাইটের আলো কমিয়ে দেওয়া, মোশন সেন্সর লাগানো বা সবচেয়ে ক্ষতিকর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কাটাতে রঙিন ফিল্টার ব্যবহার করা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃত্রিম-আলোতে বিশ্ব ভরে গেছে। শহরে অনেক সময় রাত ও দিনের পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে পরে । অনেক শহর কৃত্রিম আলোয় দিনের ফ্লেভার পায়। উন্নত দেশের বেশিরভাগ শহর তো এরকমই। কায়রোকে তো বাজারের শহর বলা হয়। রাতের বেলায় জাঁকজমক বেশি হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধান শহরগুলো এমনকি জেলা বা মফঃস্বল অনেক শহরে আলোর খেলা চলে রাতে। কসমেটিক বা বিপনীকেন্দ্রগুলোতে রাতেই উপচেপড়া ভিড় হয়। কর্মব্যস্ত মানুষ রাতেই বাজার বা মার্কেট করতে চায়। বাচ্চারাও কৃত্রিম আলোর নাচুনীতে মুগ্ধ হয়ে অভিভাবকদেরকে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রভাবিত করে। এ সংখ্যা এখন বেড়েই চলেছে। কসমেটিক বা বিপনীকেন্দ্রগুলোর কৃত্রিম আলো বাচ্চাসহ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। দেখা যায় অনেক শহরে দিনের আলোর চেয়ে রাতে কৃত্রিম আলোয় আকাশ জ্বলজ্বল করে। রাতের বেলা আকাশ বা গ্রহ-তারা কৃত্রিম আলোর ছটায় পরিস্কার দেখা যায় না। লোকালয়ের অনেক দূরে দেখতে যেতে হয়। তখনই আমরা ধরে নেব আলোক দূষণ চরম মাত্রায়।
তারা বলেন, বিশ্বে উৎপাদিত বিদ্যুতের এক-চতুর্থাংশ কৃত্রিম আলো তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। অতিরিক্ত আলোর এলাকায় বিলবোর্ডের আলোর ঝলকানিতে গাড়ির চালক নিশানা ভুল করতে পারেন। আলোকসংকেত নাও দেখতে পারেন। আমাদের রাজধানীর বা বড় শহরের রাস্তার দুধারে অনেক আলোক বিলবোর্ড আছে। কৃত্রিম আলোর জন্য যে শক্তি ব্যবহার করা হয়, তার ৩০-৬০ ভাগ পর্যন্ত অপচয় হয় বলে জানা যায়। সড়কবাতি, বিলবোর্ড ইত্যাদি ব্যবহারের প্রয়োজনে আলো যাতে কম ছড়ায়, তা খেয়াল রাখতে হবে। অনেক দেশেই আবিষ্কৃত (যেমন জার্মানি) হয়েছে লক্ষ্যবস্তুতে আলোকিত করার বাল্ব। এতে চারদিকে আলো ছড়িয়ে যাবে না। কিন্তু আমাদের অনেক অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য থাকে লোক দেখানো বা জাঁকজমক করা। এতে আলোর অপচয় হবে। আলো দূষিত হবে। জনসচেতনতাই কেবল পারে আমাদের দেশে আলোক-দূষণ কমাতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৭
আপনার মতামত জানানঃ