চা বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্থকরী পণ্য। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলা চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চল। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ শিল্পের অবদান কম নয়। বর্তমানে বিশ্বের ২৫টি দেশে বাংলাদেশের চা রপ্তানি হচ্ছে। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বড় একটি অংশ চা শ্রমিক। দীর্ঘ সময়ে চা শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখা সত্ত্বেও শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়ন ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নেই বললেই চলে।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, চা বাগানে কর্মরত নারী ও শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণে যথেষ্ট ঘাটতিসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট বিভাগের অগ্রগতির ধীরগতি।
সম্প্রতি “সিলেট বিভাগে নারী চা বাগান শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি” শীর্ষক ইউএন ওমেন বাংলাদেশের ওয়েবিনারে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, চা বাগানে কর্মরত নারী ও শিশুদের মৌলিক চাহিদার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট বিভাগের অগ্রগতির ধীরগতির কথাও উঠে আসে গবেষণায়।
ওয়েবিনারে আলোচনার প্রধান বিষয়গুলোর মধ্যে ছিলো জেন্ডার রেসপন্সিভ প্ল্যানিং অ্যান্ড বাজেটিং (জিআরপিবি) এবং চা বাগানের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বিসিএসইউ) সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, প্রতিটি চা বাগানের শ্রমিক দৈনিক মজুরি হিসেবে মাত্র ১২০ টাকা পান। সরকার এবং চা বাগান মালিকরা এটি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আইন সংস্কার কমিটি চা শ্রমিকদের দাবি শোনেনি। শুধুমাত্র মালিকরা এই ধরনের আলোচনায় উপস্থিত থাকেন।
ইউএন উইমেন বাংলাদেশের এজেন্সি প্রধান গীতাঞ্জলি সিং অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। চা বাগান শ্রমিকদের কম মজুরির কথা শুনে তিনি হতবাক হয়ে বলেন, চা শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো সম্পূর্ণ অমানবিক এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর মানোন্নোয়ন করা প্রয়োজন। আমি বুঝি না কীভাবে মালিকরা প্রতিদিন চা শ্রমিকদের ১১৭-১২০ টাকা দিতে পারে।
চা বাগানের শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘের যৌথ কর্মসূচির আওতায় সিলেট বিভাগে জিআরপিবি নিয়ে দুটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এবং পরেরটি ২০২১ সালের মার্চে।
নারী শ্রমিকরা মাসিক ঋতুস্রাব, মাতৃত্ব এবং সন্তান পরিচর্যার সময়ে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সমস্যার শিকার হয়। কর্মসূচিতে দেখা যায়, তারা বৈরী প্রতিকূল আবহাওয়ায় দিনে ৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কাজ করে। পক্ষান্তরে বিশ্রাম ও পরিচ্ছন্নতার সুযোগ সীমিত।
এছাড়া, চা বাগানের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহ, যৌতুক এবং পারিবারিক সহিংসতাও নৈমিত্তিক ঘটনা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের জন্য অনেক ক্ষেত্রে চা–বাগানের নারী শ্রমিকেরা বৈষম্যের শিকার হন। চা-বাগানে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মা সুস্থ না হলে সমৃদ্ধ জাতি পাব না। চা-শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। শ্রমিকেরা যদি অতিরিক্ত কাজ করেন, অবশ্যই অতিরিক্ত মজুরি দিতে হবে। নারী শ্রমিকদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে আইন দরকার।
চা-বাগানের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না। তাই মা ও শিশু উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরে আসতে পারে না। চা-বাগানের মায়েদের মাতৃত্বকালীন সময়েও কাজ করতে হয়। চা-বাগানে কুসংস্কার কাজ করে। নবজাতকের ভালোভাবে যত্ন নেওয়া হয় না।
তারা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিরোধমূলক সেবা ও চিকিৎসাসেবা— সুস্থ ও সবল থাকতে হলে এই তিন ধরনের সেবা প্রয়োজন। তবে সবার আগে অবশ্যই আমাদের প্রতিরোধমূলক সেবা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু নির্দিষ্ট কিছু বাগানেই না, সব চা-বাগানে জরিপ করে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে সময়মতো সরকারি হাসপাতালে মায়েদের পাঠাতে হবে।
আরও বলেন, চা-বাগানের প্রায় অধিকাংশ শ্রমিক কম লেখাপড়া জানেন। ফলে তাদের গর্ভবতী মা বা কিশোরী গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকে না। আমাদের উচিত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে চা–বাগানে কর্মরত গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রমুখী করা।
তারা বলেন, চা-বাগানে জন্মনিবন্ধন ও প্রসবকালীন পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চা-বাগানে মা ও শিশুস্বাস্থ্যসেবায় সরকার পঞ্চায়েত, শ্রমিক প্রতিনিধি, মালিকপক্ষ ও ইউপি জনপ্রতিনিধির সমন্বয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে পারিনি। তার একটা কারণ, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান যতটা উন্নত করার প্রয়োজন ছিল, ততটা এখনো হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, তা ছাড়া প্রজননস্বাস্থ্যসেবা, গর্ভপাত, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ, প্রজননতন্ত্রের মাধ্যমে সংক্রমিত রোগসমূহ, নারীর প্রতি সহিংসতা, জরায়ুর ক্যানসার—এগুলো চা–বাগানের শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা। এর সঙ্গে বাল্যবিবাহও মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারা যেমন হাসপাতালে যাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, পরিবার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ