এই মুহূর্তে রোহিঙ্গারাই সম্ভবত সবচেয়ে নিগৃহীত ও উপেক্ষিত জাতি যাদের নিজেদের দেশে বসবাসের উপায় নেই। আবার বাংলাদেশ তাদের শরণার্থী হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় না। ফলে এদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন। তবে এমন বক্তব্য যারা দিয়ে যাচ্ছেন তারা খুব ভালো করেই জানেন যে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে এতটাই নাজুক যে খুব সহসাই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার কোনও উপায় নেই।
আন্তর্জাতিকভাবে উপেক্ষিত
মিয়ানমারের সামরিক শাসন, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় থাকার পর এ অঞ্চলসহ ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে এখন আর নেই। সঙ্কট সমাধানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য গত চার বছরে মিয়ানমার সরকার তিনবার ঘোষণা দিয়ে একবারও কথা রাখেনি।
যদিও প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে এখনও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেনি দেশটি। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ও চীন-রাশিয়া-ভারতের মতো পরাশক্তিগুলোর স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে রোহিঙ্গা সঙ্কট দিন দিন স্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার বছর পূর্তিতে এসে এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো শুরুর কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে এখন রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে জোর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংকট দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি সম্পর্কিত বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে নিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশকে।
এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য এককভাবে চীনের ওপর নির্ভর না করে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষকে সঙ্গে নিতে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দরকার।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা
২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন, জ্বালাও-পোড়াও, ধর্ষণ, অপহরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করা শুরু করে। বাড়িঘর হারিয়ে ও প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পৃথকভাবে জাতিসংঘের সঙ্গে দুটি চুক্তি সই করেছে। এর মধ্যে মিয়ানমার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিকে (ইউএনডিপি) যুক্ত করে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল।
কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও জাতিসংঘ সেখানে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কয়েকটি প্রকল্প নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিৎ আশ্রয়দাতা দেশগুলোতে রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করার পাশাপাশি তাদের সুরক্ষায় বিকল্প কিছু ভাবা। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে আশা শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। সেসব দেশে রোহিঙ্গাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে উঠেছে।
মিয়ানমারে অবাঞ্চিত
মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরুর পর রাখাইনের নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সন্ধ্যা হলেই পুরো রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা দিনের বেলাতেও রাজ্যের বেশ কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাদের তুমুল লড়াই হয়েছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকার সঙ্গে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা বিনিময় করেনি নেপিডো। বাংলাদেশের তরফ থেকে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত দফায় দফায় নেপিডোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হলেও তাদের থেকে উৎসাহব্যঞ্জক জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়ক্ষেপণ করা এবং কথা দিয়ে কথা না রাখা মিয়ানমারের পুরনো কৌশল। চলমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ঢাকাকে বহুমুখী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
এর মধ্যে রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে করোনার টিকাদান শুরু করা হলেও নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে জনবহুল আশ্রয়শিবিরগুলোতে ঠাঁই নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের এ উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেই তাদের।
রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসক খিউ লিউইন রাখাইনের সিত্তে এলাকা থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, সিত্তে অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মানুষ যেমন: বয়স্ক ব্যক্তি, স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারি কর্মী ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে ১০ হাজার টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান এ কর্মসূচিতে আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাসকারী কোনো মুসলিমকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেই।
বিশ্বব্যাংকের বিতর্ক
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ১৬টি দেশকে শরণার্থীদের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে বলেছিল, আশ্রয়দাতা দেশগুলোকে শরণার্থীদের সেসব দেশের নাগরিকদের মতপ্রকাশ, চলাচল, ব্যবসা করা, সম্পত্তি কেনাবেচাসহ ভোট উৎসবে অংশ নেওয়ার অধিকার দিতে হবে। এজন্য বিশ্বব্যাংক তাদের দুই হাজার কোটি ডলারের তহবিল থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সহযোগিতা করবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে বিশ্বব্যাংক তাদের প্রস্তাবিত ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’টি মতামতের জন্য পাঠায় এবং চিঠিতে উল্লেখ করে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে কোনও মতামত না পেলে ওই প্রস্তাব সরকার মেনে নিয়েছে বলে তারা ধরে নেবে। বিশ্বব্যাংকের এই রিফিউজি পলিসি রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য দেশে অবস্থিত সব উদ্বাস্তুর জন্য প্রযোজ্য।
যদিও বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন সামনে আসলে তা প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ। পরে সংস্থাটির ঢাকা অফিস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে এমন কোনো প্রস্তাব দেয়নি। তবে রোহিঙ্গার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এমন অবস্থান গোটা বিশ্বেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অন্যান্য দেশের অবস্থান
আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোটাদাগে ভূমিকা রাখতে পারতো তারা বাংলাদেশকে আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চীনের ওপর বাংলাদেশ আস্থা রাখলেও চীন বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের পক্ষে। যেন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্নখাতে যায়। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বার বার ভেটো প্রয়োগ করেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে।
কেবল চীনের কারণেই মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। এক পর্যায়ে চাপ দিয়ে চুক্তি করিয়েছে, অন্তরালে থেকে প্রত্যাবাসন নাটকও করিয়েছে৷ জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনরকম ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
জাতিসংঘ গাম্বিয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ণ নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়। তবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার সময়টাতে মিয়ানমারকে সাহস যোগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটি সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তখন মিয়ানমারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কয়েকশ কোটি ডলার প্রকল্পের চুক্তিও সই করে চীন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের পাশাপাশি ভারতের মতো বন্ধুদেশকেও কখনও পাশে পায়নি বাংলাদেশ। চীন ও ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি দেশই কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়াও মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নজর আছে খনিজসম্পদের দিকেও। ইতিমধ্যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্যাসপম’ মিয়ানমারে অফিস খুলেছে।
অন্যদিকে, অং সান সুচির সময়ে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে জাপান। পাশাপাশি রাখাইনের মংডুর কাছাকাছি পরিকল্পিত ইকোনমিক জোনে জাপান বিশাল লগ্নিরও পরিকল্পনা করেছে। জাপান জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন না জানালেও খুব একটা বিরোধিতাও করছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তাদের রয়েছে একটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর অত্যাচার ও নির্যাতনের দগদগে অতীত। এবং বর্তমানটাও কোনোভাবেই সুখকর নয়। ভিন দেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করার মধ্যে কোনোভাবেই আত্মতৃপ্তি, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা থাকতে পারে না। তাছাড়া, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবেও স্বীকার করে না, যদিও সেটার নানান আইনি এবং কারিগরি দিক আছে। তাই, প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা নিয়ে, এবং জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই রোহিঙ্গাদের একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিহিত আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২৩৫৩
আপনার মতামত জানানঃ