মশা মারতে বছরে শতকোটি টাকা ব্যয়; তবে লাভ হচ্ছে না কোনওকিছুতেই। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে; সেই সাথে বাড়ছে ব্যয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মশার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে শুধু ওষুধ ছিটালে হবে না, প্রয়োজন কার্যকর ওষুধ ও সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনা। তবে সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে নেই অভিজ্ঞ লোক। ব্যয় করা হচ্ছে শতকোটি টাকা, ফল পাওয়া যাচ্ছে না আশানুরূপ।
এমন পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশা দিবস। ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালে আবিষ্কার করেন, অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে। তার স্মরণে প্রতিবছর ২০ আগস্ট মশা দিবস পালন করা হয়। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘শূন্য ম্যালেরিয়া লক্ষ্যে পৌঁছানো’।
মশা মারতে কামান দাগা
মশকনিধনে বেশি অর্থ ব্যয় করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। গত অর্থবছরে মশকনিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন খরচ করেছে সাড়ে ৫০ কোটি টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খরচ করেছে ৪৪ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশকনিধন সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ রেখেছে ১২০ কোটি টাকার বেশি।
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন গত অর্থবছরে ব্যয় করেছে প্রায় ১১৩ কোটি টাকা। এ টাকার বড় অংশ গেছে কীটনাশক কেনা ও ছিটানোর যন্ত্র ক্রয়ের কাজে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাবে, ৯টি সিটি করপোরেশন মশকনিধনের জন্য বরাদ্দ রেখেছে প্রায় ১৪১ কোটি টাকা। রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এখনো মশকনিধনে বরাদ্দ দেয়নি।
তবে শতকোটি টাকা ব্যয় করেও চলতি বছরের জুন মাসের শেষ থেকে রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। ফলে মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ২৫১ জন।
এদের মধ্যে গতকাল ১ হাজার ২৩৮ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাদের মধ্যে ১ হাজার ১৪৫ জনই ভর্তি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। চলতি বছর ৩১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
অকার্যকর কমিটি
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ গত বছরের ৬ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। এক মাসের মধ্যে কমিটির সুপারিশ জমা দেওয়ার কথা থাকলেও, এক বছর সাত মাস পেরিয়ে গেছে; কমিটি কোনো সুপারিশ জমা দেয়নি। সভাও করেছে মাত্র একটি। এই কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন)। কমিটির সভা ডাকা ও সুপারিশ তৈরির কাজ এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আহ্বায়কের।
কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০১৯ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ার পর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখের বেশি মানুষ। সরকারি হিসাবে মারা যান ১৭৯ জন, যা বেসরকারি হিসাবে ৩০০ জনের বেশি।
এমন অবস্থায় ওই বছরের মাঝামাঝি ও ২০২০ সালের শুরুতে মশকনিধনের উপায় খুঁজতে স্থানীয় সরকার বিভাগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সভা করে। এসব সভায় বিশেষজ্ঞরা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে মশক নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম না চালিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট) গড়ে তোলার সুপারিশ করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সুপারিশ দিতে কমিটি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর সদস্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমান বলেন, গত বছর কমিটির একটি সভা হয়েছিল। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিনি বলেন, ‘মশকনিধন এখন “মৌসুমি টেনশন” হয়ে গেছে। যখন রোগী বাড়ে তখন হইহল্লা করি, রোগী কমলেই আলোচনা থেমে যায়। মশা সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার।’
অনভিজ্ঞ লোকের ছড়াছড়ি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু বিস্তারে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে গৃহপালিত ও নগরকেন্দ্রিক এডিস ইজিপ্টি মশা। ডেঙ্গু বিস্তারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভূমিকা রাখে এডিস এলবোপিকটাস, যাকে ‘এশিয়ান টাইগার’ মশা বলা হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই এ মশা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে গবেষণা দরকার, কোন ওষুধে কোন মশা মরে, তা বের করা দরকার, মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও থাকতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, মশার সমস্যা সারা দেশেই। কেন্দ্রীয়ভাবেই মশার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা হওয়া উচিত। মশা মারতে কীটনাশক নির্ধারণ, মশা নিয়ন্ত্রণে গবেষণার কাজ করবে কেন্দ্রীয় মশা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র।
তিনি বলেন, কেন্দ্র করে যাকে-তাকে দায়িত্বে বসিয়ে দিলে হবে না, মশক নিয়ন্ত্রণে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ