ছাত্রলীগ এখন কেবল ছাত্রসমাজের কাছে এখন আতঙ্কের নাম নয়, গোটা দেশের নিকট আতঙ্কের নাম। ছাত্র রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি মাস্তানির মহাউৎসবে মেতে উঠেছে এই সংগঠনটি। থেমে নেই করোনা মহামারির এই দুর্যোগ মুহূর্তেও। সম্প্রতি ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। আর নেতার এই চাদাবাজিতে পুলিশ সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ।
অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম নিউজবাংলা থেকে জানা যায়, রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় গাড়ি থামানোকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, টাকা নেয়ার কাজে ওই ছাত্রলীগ নেতাকে সহযোগিতা করেছেন শাহবাগ থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে চানখারপুলের নাভানা ফিলিং স্টেশনের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠা ছাত্রলীগ নেতার নাম ফেরদৌস আলম। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। অন্যদিকে ফেরদৌসকে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠা পুলিশ কর্মকর্তার নাম নাসির উদ্দীন। তিনি শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই)।
গাড়ির মালিক মেহেদি হাসান মুন্নার অভিযোগ, ঘটনাস্থলে উপস্থিত নাসির উদ্দীনের মাধ্যমেই চাঁদাবাজি করেছেন ফেরদৌস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাত ১টার দিকে একটি মাইক্রো চানখারপুল-বুয়েটের রাস্তার বাম পাশের নাভানা ফিলিং স্টেশনের সামনে দাঁড়ায়। মাইক্রোচালক তার ডান পাশের দরজা খুলে বের হওয়ার সময় পেছন থেকে আসা মোটর সাইকেলের গতিরোধ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘মোটর সাইকেলে কোনো আঘাত লাগেনি। মোটরসাইকেলে একজনই ছিল আর মাইক্রোতে ছিল দুই জন। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে এটি নিয়ে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়। আমরা সেখানে পৌঁছালে ঘটনাস্থলে আগে থেকেই উপস্থিত মোটর সাইকেল আরোহীর এক সহযোগী আমাদের চলে যেতে বলে। তাই আমরা চলে আসি। এর বেশি কিছু জানিনা।’
গাড়ির মালিক মেহেদি হাসান মুন্না বলেন, ‘আমরা গাড়ি থামিয়ে নামতে যাব এমন সময় পেছন থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে ছাত্রলীগের ওই ছেলে এসে আমাদের ধমকাতে শুরু করে। আমার ড্রাইভারও তাকে একটা গালি দেয়। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত মোটরসাইকেল আরোহীর এক সহযোগী বলে, দশ-বিশ হাজার টাকা দেন। সে রেগে আছে। বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যাক। আর নাহলে আমি সামাল দিতে পারব না। বুঝেন ত, পোলাপানের কিছু খরচ আছে।’
তিনি বলেন, ‘তাদের কথা শুনে বুঝতে পারি এটি পূর্ব পরিকল্পিত। তারা একটা সিন্ডিকেট। আমি ৯৯৯ নাইনে ফোন দিলে পুলিশ আসে। তবে বাইকওয়ালা ছাত্রলীগের পদে থাকায় পুলিশও তাদের সরাসরি কিছু বলছিল না। উল্টো পুলিশ আমাদের বলে, আপনারা যদি বিষয়টা এখানেই মিটিয়ে ফেলতে চান তাহলে আমি চলে যাব। আর নাহলে থানায় চলেন।
‘আমরা ওই রোডে নতুন হওয়ায় কোনো উপায় না পেয়ে পুলিশের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে চলে আসি। ফেরদৌস সেখানে উপস্থিত ছিল৷ তার কথা মতোই আমি টাকাটা পুলিশের হাতে দেই।’
‘আমরা ওই রোডে নতুন হওয়ায় কোনো উপায় না পেয়ে পুলিশের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে চলে আসি। ফেরদৌস সেখানে উপস্থিত ছিল৷ তার কথা মতোই আমি টাকাটা পুলিশের হাতে দেই।’
অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতা ফেরদৌস আলম বলেন, ‘তারা ভুল জায়গায় গাড়ি থামিয়ে নামতে চাইলে আমি হঠাৎ ব্রেক করায় গাড়িসহ পড়ে যাওয়ার উপক্রম হই। এ নিয়ে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হলেও আমি চলে যাওয়া শুরু করি। কিন্তু গাড়ির মালিক পেছন থেকে হঠাৎ আমার কলার ধরে বসেন।
‘এরপর আমি রেগে যাই। এ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আমাদের মাঝে বাগ-বিতণ্ডা হয়। এর মধ্যে পুলিশও চলে আসে। তারপর ছাত্রলীগের কয়েকজন বড় ভাই থেকে ফোন আসায় আমি শান্ত হই৷ কার মালিক আমাকে স্যরি বলায় আমি সেখান থেকে চলে আসি।’
চাঁদা নেয়ার বিষয়ে ফেরদৌস বলেন, ‘এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাদের সঙ্গে টাকার বিষয়ে কোনো কথাই হয়নি। তবে শুনেছি নাভানার সামনের ঘটনা শেষ করে বকশিবাজারের সামনে যায় কার মালিক এবং পুলিশ। সেখানেই কার মালিক পুলিশকে পাঁচ হাজার টাকা দিছে।’
অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক নাসির উদ্দীন বলেন, ‘এ ঘটনায় দুজনেরই দোষ আছে। দুই পক্ষকে বুঝিয়ে নাভানার সামনেই মীমাংসা করে দেয়া হয়৷ কোনো টাকার বিনিময় হয়নি।’
ফেরদৌস আলমের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে নাসির বলেন, ‘প্রশ্নই উঠে না। ঘটনাটা ঘটেছে তাদের দুই জনের মধ্যে। আমি ৯৯৯ নাইনের ফোন পেয়ে এসেছি। টাকা বিনিময় হলে তাদের মাঝে হওয়ার কথা। আমাকে টাকা দিবে কেন? তিনি (ফেরদৌস) কোন উদ্দেশ্যে এ কথা বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ যে আদর্শ ও নীতিতে একটি সংগঠনে রুপ নিয়েছিল সেই আদর্শ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদর্শের চর্চা না থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সর্বগ্রাসী নতুন রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যাকে পারো তাকে ধরো, আওয়ামী লীগ করো নীতিতে চলতে গিয়ে ছাত্রলীগ আর আগের মতো আদর্শিক ছাত্রলীগ হতে পারছে না। তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে নেই। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। আর ছাত্রলীগও তাদের ব্যবহার করে ধান্দার রাজনীতি করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের এই আইনের উর্ধে চলে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক নেতা কুৎসিত হাতের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনটির ছাত্রদের ধীরে ধীরে উগ্র এবং একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে রুপদানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক মদদ ও উস্কানি। এ বিষয়ে প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনকে ব্যবহার করে তাদের চাঁদাবাজি ও নানা অপকর্ম একদিকে যেমন পুলিশের জন্য লজ্জার অপরদিকে দেশের জন্যও। সাম্প্রতিককালে পুলিশের এহেন অপকর্মের অভিযোগ সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি পরিমাণে আসছে। পুলিশের কাছে অনেকটাই জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, কর্মজীবীরা। কিছু হলেই সন্ত্রাসীদের চেয়ে ভয়ানক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হয়। যখন তখন ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে লুটে যাচ্ছে প্রচুর টাকা। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, লকডাউনে বিভিন্নভাবে পুলিশের দ্বারা ভোগান্তিতে পড়ছে নিম্ন আয়েরসহ সকল শ্রেণির মানুষ। ট্রাফিক পুলিশ কিংবা কন্সটেবলের দ্বারা যেনো ভোগান্তির নিরসন ঘটে শীঘ্রই সেজন্য উপরমহল থেকে আরও বেশি নজরদারি করা উচিৎ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা এবং পুলিশের দ্বারা কোনো অপরাধমূলক কাজ ঘটতে দেখলে সেটার শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক বলেও মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৩
আপনার মতামত জানানঃ