জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব চলছে ইউরোপ জুড়ে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভয়াবহ দাবানলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রিস, তুরস্ক, রাশিয়া ও ইতালি। সেই ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার ইতালির সিসিলিতে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হলো। এটি ইউরোপের এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশকিছু অঞ্চলে চরম তাপমাত্রার জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছে এবং শুক্রবারের মধ্যে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হওয়া শহরগুলোর সংখ্যা আট থেকে ১৫ পর্যন্ত বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইতালিতে এত বেশি তাপমাত্রা আগে কখনো হয়নি। ইউরোপের ক্ষেত্রেও সম্ভবত রেকর্ড তাপমাত্রা। আগে থেকেই ইতালি দাবানলের কবলে ছিল। এই তাপমাত্রায় দাবানল আরো ছড়াচ্ছে।
সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিসিলি ও সার্ডিনিয়ার অবস্থা নিয়ে তারা চিন্তিত। একে প্রবল গরম, তার উপর জোরে হাওয়া বইছে। ফলে দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে অসুবিধা হচ্ছে। সিসিলিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সরকারি কর্মীরা অবশ্য দাবি করছেন, আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়েছে।
দক্ষিণের এলাকা ক্যাটানজারোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একটি মিউজিয়ামের চারপাশে আগুন ছড়িয়েছে। তারা এখন সেই আগুনের সঙ্গে লড়াই করছেন।
ভূ-মধ্যসাগরের অপর প্রান্তের সাহারা মরুভূমির লো হাওয়া ইতালি উপকূলে বারবার এন্টি সাইক্লোন জোন গড়ে তুলে চরম দাবদাহ সৃষ্টি করে। দেশটির প্রায় অধিকাংশ স্থানে তীব্র তাপদাহে স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশটিতে ভ্রমণে আসা লাখ লাখ পর্যটক ভোগান্তিতে পড়েছে।
গত সপ্তাহে সিসিলি ও পেসকারার ভয়াবহ আগুনের পাশাপাশি দক্ষিণের পুগলিয়ার গ্রাভিনা শহর এবং উত্তরের স্যান গিয়াকোমো ডেগলি শিয়াভোনিতেও আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া শুষ্ক ও ঝড়ো হাওয়া প্রবাহের ফলে দক্ষিণ ফ্রান্সেও সতর্কতা জারি করা হয়।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি স্পেনেও তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। বুধবার স্পেনের কোস্টা দেল সোলে ১১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে দেশটির আবহাওয়া পরিষেবা এইএমইটি। সেইসঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের তাপমাত্রাও ১১১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এইএমইটি আরও জানায়, ‘বছরের এ সময় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় পৌঁছাবে।’ সেইসঙ্গে মেইনল্যান্ড স্পেন এবং বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ সাম্ভাব্য তাপদাহের মুখোমুখি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সংস্থাটির একজন মুখপাত্র।
স্পেনের পাশাপাশি গ্রিসেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব দেখা দিয়েছে। দেশটির কিছু প্রান্তে তাপমাত্রা ১১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছানোয় সেখানের জনসাধারণকে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে সতর্ক করা হয়েছে।
সিভিয়ার ওয়েদার ইইউ এর প্রধান পূর্বাভাসকারী মার্কো কোরোসেক বলেছেন, ইউরোপজুড়ে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এ সপ্তাহের শেষের দিকে স্পেন ও পর্তুগালে আরও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে। সপ্তাহের শেষের দিকে এ তাপদাহ সম্পূর্ণ আইবেরিয়ান উপদ্বীপজুড়ে প্রবাহিত হবে বলে যোগ করেন তিনি।
তাছাড়া, পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও কস্তা এক সতর্কবার্তায় জানান, উষ্ণ এ আবহাওয়া দাবানলের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। তিনি বলেন, বর্তমানে গ্রিস ও তুরস্কের ‘ভয়াবহ চিত্র’ তাকে ২০১৭ সালের দাবানলে শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করার কথা মনে করিয়ে দেয়। এ পরিস্থিতিতে কস্তা পর্তুগালের মানুষকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন।
যদিও স্পেন ও পর্তুগালের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে তুলনামূলক বেশিই থাকে, তবু জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বর্তমান অবস্থার জন্য পরিবেশ বিপর্যয়কে দায়ী করছেন। তারা বলেন, কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়ানোর ফলে তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল, বন্যা ও ঝড়ের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি চলছে এখন বিশ্বজুড়ে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বর্তমান অবস্থার জন্য পরিবেশ বিপর্যয়কে দায়ী করছেন। তারা বলেন, কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়ানোর ফলে তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল, বন্যা ও ঝড়ের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি চলছে এখন বিশ্বজুড়ে।
গবেষকেরা বলছেন, এসব বিপর্যয় আমাদের গ্রহে আরও ঘন ঘন ঘটবে বলে ধারণা করা যায়।
ইউরোপে এই তাপদাহের সূচনা হয় অ্যালিকান্তে রিসোর্টে মেটিও সুনামি আঘাত হানার পর। এ সুনামি সেখানকার রাস্তাঘাট, সৈকত, যানবাহন ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া গত বুধবার রাতে সান্তা পোলাও আবহাওয়ার ছোবলের সম্মুখীন হয়। এ অঞ্চলগুলোতে আঘাত হানা সুনামির মতো বিশাল ঢেউ আদতে জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপদাহের ফলেই সৃষ্ট। বিরল আবহাওয়ার কারণে শহরটির নৌবহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় সান্তা পোলার পুলিশ।
এছাড়া, সান্তা পোলার দক্ষিণে গার্ডামারেও গত বুধবার একটি মেটিওসুনামি আঘাত হানে। এ সুনামির ফলে সে অঞ্চলের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৮০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় উঠে আসে।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির লো হাওয়া, ইতালির দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা তপ্ত জলরাশির ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে বিশাল এলাকা জুড়ে এন্টি সাইক্লোন জোন গড়ে তোলে। এতেই সৃষ্টি হয় তীব্র তাপদাহ ও প্রচণ্ড গরম। পূর্বের অন্যান্য বছরগুলোতে বছরে দুয়েকবার এমন তীব্র তাপদাহ সৃষ্টি হলেও সম্প্রতি বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘন ঘন তীব্র তাপদাহ সৃষ্টি হচ্ছে ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় এলাকায় দেশগুলোতে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, আফ্রিকা থেকে বয়ে আসা গরম বাতাসের কারণে স্পেন ও পর্তুগালে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে।
ইউরোপের আবহাওয়া সতর্কতা দেওয়া গ্রুপ মেটেওএলার্ম এরইমধ্যে বিপজ্জনক লাল সতর্কবার্তা জারি করেছে। পর্তুগালের দক্ষিণাঞ্চল ও স্পেনের বাদাজোজ প্রদেশের তাপপ্রবাহকে জীবনের প্রতি হুমকি বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে গ্রুপটি।
মেটেওএলার্ম তাদের সতর্কবার্তায় বলেছে, এথেন্সের ৪৮ ডিগ্রি রেকর্ড ছোঁয়ার আশঙ্কা রয়েছে ৪০ শতাংশ আর ইউরোপীয় রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ডে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে ২৫-৩০ শতাংশ।
ইতোমধ্যে তীব্র গরমের কারণে গ্রিসে দাবানলে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৯০ জন। আর সুইডেনকেও বেশ কয়েকটি দাবানল সামাল দিতে হয়েছে। ইউরোপে দাবানলের ঘটনা নিয়মিত হলেও শুষ্ক আর গরম আবহাওয়া পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
গত সোমবার প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়, বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ অবস্থা খুব দ্রুতই খারাপের দিকে যাবে।
জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ২০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে বলে ভেবেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখন তারা বিশ্বাস করছেন, সেটি এ বছর থেকে শুরু করে ২০৪০ সালের মধ্যেই ঘটবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৭
আপনার মতামত জানানঃ