মহামারিতে বেড়েছে সন্ত্রাস, বেড়েছে অপরাধপ্রবণতা। শিশুরাও বৃহৎ পরিসরে জড়িয়ে পড়েছে এসবে। মহামারিতে বিভিন্ন অভিযোগে আটক শিশু-কিশোরদের প্রায় অর্ধেকই হত্যা ও ধর্ষণ মামলার আসামি। বর্তমানে দেশের তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে মোট নিবাসীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৩। গত বছরের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরই এই শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়ে উন্নয়ন কেন্দ্রে এসেছে।
শিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া
গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ী ও যশোরের তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা নিবাসীদের মামলার তথ্য অনুসারে, ২৪ শতাংশের বেশি শিশুর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা এবং আর প্রায় ২৬ শতাংশ শিশু আসামি হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায়, যার অধিকাংশই ধর্ষণের মামলা। তবে অনেক শিশুর পরিবারের অভিযোগ, ষড়যন্ত্র করে তাদের মামলায় আসামি করা হয়েছে।
ওই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে ২৬৩ জন শিশুর (২৪ দশমিক ১ শতাংশ) বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রয়েছে। দুটি বালক কেন্দ্রের ৯৮৫ নিবাসীর মধ্যে ২৫৩ জনের (২৫ দশমিক ৬ শতাংশ) বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি ১৭৪ জন, যাদের দু-একজন বাদে সবার বিরুদ্ধেই ধর্ষণের অভিযোগ।
টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) ৩০০ আসনের বিপরীতে আছে ৭২৩ শিশু-কিশোর। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ১৮২ শিশুর বিরুদ্ধেই হত্যা মামলা। এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি ১৮২। তাদের মধ্যে দু-একজন বাদে সবার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা বলে এখানকার তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান জানিয়েছেন।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) ১৫০ আসনের বিপরীতে ২৬২ শিশু-কিশোর রয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৯ শিশুর বিরুদ্ধে হত্যা এবং ৭৩ শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা রয়েছে।
কোনাবাড়ীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা) ১৫০ আসনের বিপরীতে নিবাসী রয়েছে ৯৮। তাদের মধ্যে ১১ জন হত্যা মামলার আসামি। সেখানে বিভিন্ন ঘটনার ভিকটিম আছে সবচেয়ে বেশি ৫৪ শিশু। এই কেন্দ্রে তিনজন মায়ের সঙ্গে নবজাতকও রয়েছে।
বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব–১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু আইনের সংস্পর্শে এলে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী এবং যশোরের পুলেরহাটের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) রাখা হয়। মেয়েদের রাখা হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা)।
টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালক) তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান বলেন, আইনের সংস্পর্শে আসা এই শিশুদের খুব বেশি দিন কেন্দ্রে থাকতে হয় না। দ্রুত জামিন হয়ে যায়। বর্তমান নিবাসীদের ৯৬-৯৭ শতাংশ করোনাকালে কেন্দ্রে এসেছে।
হাতে গোনা কয়েকটি শিশু দুই থেকে তিন বছর ধরে কেন্দ্রে অবস্থান করছে। প্রায় ১৭ মাস ধরে দেশে করোনা মহামারি চলছে। এর মধ্যে দুই দফায় পরিচালিত ভার্চ্যুয়াল আদালত থেকে জামিন পেয়ে দেড় হাজারের বেশি শিশু-কিশোর মুক্ত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট ও ব্র্যাকের তথ্যানুসারে, করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে শুরুর দিকে গত বছরের মার্চ ও এপ্রিলে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। জামিনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে গত বছরের ৫ মে ভার্চ্যুয়াল আদালত শুরু হয়। চলে ২০ জুন পর্যন্ত। ওই সময়ে জামিন পায় ৫৬১ শিশু।
এরপর আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। এ বছর করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে ১২ এপ্রিল আবারও ভার্চ্যুয়াল আদালত শুরু হয়। জুলাই পর্যন্ত জামিন পেয়েছে ১ হাজার ১৫ শিশু।
কেন গুরুতর অপরাধে জড়াচ্ছে শিশুরা
গত বছরের শেষ দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় এক শিশু হত্যা মামলায় ছয় আসামির মধ্যে ১২ বছরের শিশুও ছিল। মামলাটি হওয়ার পর টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় শিশুটিকে। পাঁচ মাস পর গত ১২ এপ্রিল ভার্চ্যুয়াল আদালত থেকে জামিন পেয়ে মুক্ত হয় সে।
ওই শিশুটির বড় ভাই বলেন, হত্যার শিকার ছেলেটি তার বাবার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। ভাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে খেলত। ছেলেটি হারিয়ে যাওয়ার চার দিন পর জঙ্গল থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। শিশুটির সঙ্গে খেলত বলে তার ভাইকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই তার ভাই ‘জড়িত নয়’।
এদিকে, টেকনাফের ১৫ বছরের আরেক কিশোরের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাহন মিনি টমটম চুরির মামলা দেওয়া হয়। চার মাস পর জুনে তার জামিন হয়। ওই কিশোরও মিনি টমটমের চালক ছিল।
এত বেশিসংখ্যক শিশু-কিশোরের হত্যা ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের মামলার আসামি হওয়া প্রসঙ্গে শিশুদের আইনি অধিকার রক্ষায় কর্মরত ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম নাজমুল হক বলেন, পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব এবং অর্থনৈতিক সংকটে থাকা অনেক পরিবারের শিশু হত্যা, ধর্ষণ, চুরি-ছিনতাই ও মাদকের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণেও অনেক শিশু এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক বিরোধ থেকেও শিশুদের মামলায় জড়ানো হয়।
এই আইনজীবীর ভাষ্যমতে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিশুই না বুঝে এতে জড়িয়ে যায়। তাদের মূলত বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমন ২০০ টাকা দিয়ে বলা হয়, প্যাকেটটা ওইখানে দিয়ে আসিস তো। যে শিশু চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, তার জন্য ২০০ টাকা অনেক।
শিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া নিয়ে একই ধরনের কথা বলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান শাখার সহকারী পরিচালক এস এম রফিকুল হায়দার। তিনি বলেন, নিবাসী শিশুদের অনেকের পরিবারে মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। শিশুদের ওপর সেসব প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া দারিদ্র্যও একটি বড় কারণ।
শিশু-কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া থেকে উত্তরণের বিষয়ে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুহেলী সায়লা বলেন, ওই শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সামাজিক বন্ধন খুব দুর্বল এবং এই সামাজিক বন্ধনহীনতা সমস্যা তৈরি করেছে। অনেকেই মা–বাবার ভালোবাসা পায় না। কোনো কোনো মা–বাবা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে তাদের রেখে চলে গেছেন। সেই পরিবার থেকে তাদের লালনপালনে সামাজিকীকরণের ধাপগুলো মেনে চলা হয়নি। গ্রামের অনেক শিশু স্কুলেও যথাযথ শিক্ষা পায়নি। আদর্শিক জায়গা থেকে তাদের সামনে কোনো ‘রোল মডেল’ নেই। অনেকে দারিদ্র্যকে কারণ বললেও তা মূল কারণ নয়।
সুহেলী সায়লা আহমদ শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নিবাসীর মানসিক অবস্থা নিয়ে পিএইচডি করছেন। তিনি গাজীপুরের দুটি কেন্দ্রে একাধিকবার গিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, প্রথমত পারিবারিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। পারিবারিক বন্ধন শক্ত হলে আর সামাজিকীকরণ হলে একটি দরিদ্র পরিবার থেকেও সুস্থ, সুন্দর মানসিকতার শিশু বেরিয়ে আসতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ