প্রতিটা সংসারেই রাগ-অভিমান ঝগড়া-বিবাদ হওয়াটা স্বাভাবিক। এমনি ঝগড়া-বিবাদের এক পর্যায়ে পঞ্চগড়ের বৃদ্ধ দম্পতি আয়নাল হক ও তার স্ত্রী জমিরন বেগম একে অপরকে মৌখিকভাবে তিন তালাক দিয়েছিলেন। পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অন্য কাজি অফিসে গিয়ে আবার বিয়ে করে সংসার করছেন তারা। কিন্তু বাদ সাধে সমাজপতিরা। তাদের এ বিয়ে মেনে না নিয়ে উল্টো ফতোয়া জারি করে তাদের একঘরে করে রেখেছেন। জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছলিমনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।
দুজনকে কথা বলতে না দেওয়া, তাদের বাড়িতে কাউকে যেতে না দেওয়া; নিজের ভাই, ছেলে, আত্মীয়স্বজনসহ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক হিল্লা বিয়ে দিয়ে এরপর সংসার করতে হবে আয়নাল-জমিরন দম্পতিকে, এমন সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দিয়েছেন সমাজপতিরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছলিমনগর গ্রামের ওই দম্পতি প্রায় ৩৫ বছর ধরে সংসার করে আসছেন। তাদের চার সন্তান ও নাতি-নাতনি আছে। দরিদ্র ওই পরিবারের টানাটানির সংসার। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে সংসারের খরচ চালান আয়নাল হক। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রোজার সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে আয়নাল হক মুখে মুখে তার স্ত্রীর প্রতি তালাক শব্দটি উচ্চারণ করেন। দ্রুত এ বিষয়টি গ্রামে জানাজানি হয়ে যায়।
বিষয়টি জানাজানি হলে ছলিমনগর জামে মসজিদের সভাপতি নাসিরউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর ইসলাম, সদস্য শাহজাহান আলী, ঈমান আলী, হাফেজ মোস্তফা কামাল, জুলহাস, গফুর আজাদ, সুরমান মেম্বার, আমির চাঁদ, আব্দুর রশিদ, দেলোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন সমাজপতি বৈঠক করেন। বৈঠকে সমাজপতিরা অন্য গ্রাম থেকে মুফতি আনোয়ার হোসাইন ও হাফেজ মোস্তফাকে আনেন। তারা ফতোয়া দেন, স্ত্রীকে হিল্লা বিয়ে দেওয়ার পর আবার বিয়ে করে সংসার করার। হিল্লা বিয়ে দেওয়ার আগে সংসার এবং একসঙ্গে বসবাস করতে পারবেন না ওই দম্পতি।
আয়নাল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, সাংসারিক ব্যাপার নিয়ে পাঁচ-সাত দিন ধরে ঝগড়া-ঝাটি করতে করতে করতে ঐদিন মাথা গরম হয়া গেছিল।”
জমিরন বেগম বলেন, এটা নিয়া সমাজে মিটিং বসছিল। একজন হুজুর বললো, ওর হিল্লা বিয়া দিতে হবে, ওর সুরুত( চেহারা) দেখা যাবে না। এটা তালাক একবারে হয়া গেছে। আমার স্বামী বললো ওর সাথে ৩০-৩৫ বছরের সংসার। চারটা বাচ্চা কাচ্চা, নাতিপুতি আছে। ওরে আমি কিভাবে বাদ দেই?
দুজনকে কথা বলতে না দেওয়া, তাদের বাড়িতে কাউকে যেতে না দেওয়া; নিজের ভাই, ছেলে, আত্মীয়স্বজনসহ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক হিল্লা বিয়ে দিয়ে এরপর সংসার করতে হবে আয়নাল-জমিরন দম্পতিকে, এমন সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দিয়েছেন সমাজপতিরা।
কয়েকদিন পরে গ্রামের বাইরে আরো কয়েকজন মাওলানার কাছ থেকে মতামত নেন এই দম্পতি। তারা বলেছেন, এই তালাক কার্যকরী হবে না।
কিন্তু তারপরেও বিষয়টিতে আশ্বস্ত হতে পারেননি সমাজের মানুষ। তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য এই দম্পতি অন্যত্র গিয়ে আবারো বিয়ে করেন।
খানসামা উপজেলার এক মাওলানার বাসায় গিয়ে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন তারা। এতে সমাজপতিরা ক্ষুব্ধ হন। পরে ছলিমনগর জামে মসজিদের সব সদস্যকে ওই দম্পতি ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করেন সমাজপতিরা। সেই সঙ্গে তাদের বাড়িতে সমাজের অন্যদের যাতায়াত, জিনিসপত্র আদান-প্রদান ও হাটবাজারে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এ অবস্থায় গ্রামের দোকানিরা ওই দম্পতির পরিবারের সদস্যদের কাছে পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেন। সমাজপতিদের চাপে দুই মাস ধরে ঘরবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
সমাজপতিরা ওই দম্পতির সঙ্গে তাদের ভাইবোন, ছেলেমেয়ে এমনকি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের দেখা ও কথা বলা নিষিদ্ধ করেছেন। তাদের সঙ্গে যারা যোগাযোগ করবে তাদেরও একঘরে করা হবে এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে বলে হুমকি দেন। এতে দুই মাস ধরে এই দম্পতি একঘরে অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
এ বিষয়ে সুন্দরদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য লক্ষ্মণ চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে জানান, আয়নাল ও জমিরন নেছা ঝগড়া করে একে অপরকে তালাক দিয়েছিল বলে আমি শুনেছি। তাদের একঘরে (বয়কট) করে রাখা হয়েছে। আমি স্থানীয় সমাজপতিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসেছিলাম কিন্তু ইসলামি আইন-কানুনের কথা বলে তারা হিল্লা বিয়ে দিতে সম্মত হয়। আমার কথা তারা না শোনায় আমি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি।
ছলিমনগর জামে মসজিদের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর ইসলাম জানান, স্থানীয় সমাজের বৈঠকে লোকজনের উপস্থিতিতে মুফতি আনোয়ার হোসাইন ও হাফেজ মোস্তফা কামাল আয়নাল ও জমিরনকে সমাজ থেকে বয়কট করেন। সমাজের লোকজনের সঙ্গে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ফতোয়া দেন।
আয়নাল হক ও জমিরন বেগমের বড় ছেলে ওমর ফারুক বলেন, আমার মা-বাবার তালাকের বিষয়টি নিয়ে সমাজপতিরা তাদের আলাদা করে দিয়েছে। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেয় না। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আমাদেরও একঘরে করে রাখা এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু আমার মা-বাবা তাদের নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা মাওলানার কাছে গিয়ে আবার বিয়ে করেন। তারপরও সমাজপতিরা আমাদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। তারা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা দিচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন জামিরন বেগম। সেখানে ১০জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
সে অভিযোগে বলা হয়, বিবাদীদের কারণে তাদের একঘরে করে দিয়েছেন এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দেবীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা প্রত্যয় হাসান বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনি এ অভিযোগটি পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আশা করি এটি দ্রুত সমাধান করা যাবে। এ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে আরবিট্রেশন কাউন্সিল আছে,”
তিনি বলেন, সমস্যাটা হচ্ছে সামাজিক। এটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবরা ভালোভাবে সমাধান করতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয় গোড়ামির কারণে সমাজের আধিপত্যবাদী সমাজপতিরা এখনো মানুষের স্বাভাবিক জীবনে হস্তক্ষেপ করছে, স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে, বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে কুৎসিত চর্চাকে লালন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে যা এই আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রে শুনতে ও ভাবতেও লজ্জা লাগে। বৃদ্ধ দম্পতিকে আধিপত্যবাদী গোড়ামি সমাজের কুৎসিত কবল থেকে মুক্ত করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। একইসাথে যারা একঘরে করে রাখার মূল আসামি তাদের শীঘ্রই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৩
আপনার মতামত জানানঃ