গত কয়েকদিনে বাংলাদেশে টিকা নেয়ার পর পরই খুব অসুস্থ হয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটা খবর পেলাম। আমারই এক সুস্থ-সবল আত্মীয় টিকা দিয়ে এসে রাতে কাপুনি দিয়ে জ্বর, পাতলা পায়খানা, শরীর মারাত্মক দুর্বল, এরকম উপসর্গ নিয়ে পুরোপুরি শয্যাশায়ী! টিকা নিয়ে একইরকম উপসর্গে একজন মারাও গিয়েছে বলে জানলাম! গ্রামের লোকজনের হয়েছে সবচেয়ে বড় হ্যাপা, তারা জানেও না টিকা নেয়ার পরে এরকম মারাত্মক অসুস্থতা শুরু হলে তারা কোথায় চিকিৎসা নিতে যাবে! টিকা কার্ডে যে স্বাস্থ্যকর্মীর নাম্বার দেয়া আছে, তাকে ফোন দিলে কোন চিকিৎসা পরামর্শ দেয়া তো দূরের কথা, কোনকিছু ভালোভাবে না শুনেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেখিয়ে দেয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও সব ওভারলোডেড! আর, টিকার কারণে এমন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, এই খবরটাও ঝড়ের গতিতে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে, টিকার ব্যাপারে ভয়, সন্দেহ এসবও ঢুকে যাচ্ছে!
ফলে, প্রশ্নটা উঠছে – করোনার টিকা কতখানি নিরাপদ? (কতখানি কার্যকর, এই প্রশ্ন তো ছিলই)
করোনার টিকা কতখানি নিরাপদ, তা টিকা ভেদে ভিন্ন হতে পারে। থিওরিটিকালি ইন-এক্টিভেটেড ভাইরাসকে ব্যবহার করে যেসব টিকা আছে, সেগুলোর চাইতে এম-আরএনএ ভিত্তিক বা ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তির টিকা অধিক নিরাপদ হওয়ার কথা, যেহেতু ইন-এক্টিভেটেড ভাইরাস শরীরে ঐ ভাইরাসের রেপ্লিকা বানাতে পারলেও এম-আরএনএ বা ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তির টিকা মূলত স্পাইক প্রোটিনই বানায়, আস্ত ভাইরাসের রেপ্লিকা তৈরি করতে পারে না! সেই হিসেবে এম-আরএনএ ভিত্তিক মডার্ণা ও ফাইজার, ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তির আস্ট্রাজেনিকা তুলনামূলক নিরাপদ হওয়ার কথা। চাইনিজ টিকা সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক ইন-এক্টিভেটেড ভাইরাস প্রযুক্তির টিকা, ফলে টিকা হিসেবে যে ভাইরাস ঢুকানো হচ্ছে তা কতখানি অকার্যকর, কত অল্প ভাইরাস বানাতে পারে, শরীরের ইম্যুউন সিস্টেম কত দ্রুত সেই ভাইরাস রেপ্লিকাকে পরাস্ত করতে পারে- তা খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়! সেক্ষেত্রে, এই অতিমারির সময়ে টিকার ট্রায়াল এত দ্রুত সমাধা করেছে বলে কিছু সন্দেহর জায়গা থাকা অমূলক নয়!
তবে, আমি করোনার ট্রায়ালগুলো এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন ঘেটে যতটুকু বুঝলাম, সবগুলো টিকার ক্ষেত্রেই প্রি ক্লিনিকাল ট্রায়াল ও তিনটা ফেজে ক্লিনিকাল ট্রায়ালে সবচাইতে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়- এই নিরাপত্তার বিষয়টি। কার্যকারিতা বা এফিকেসি যেমনই হোক, সেফটি ব্যাপারে নো-টলারেন্স নীতি নিতে দেখেছি। এই সিনোফার্মের টিকাই দুটো দেশে দুজন টিকাগ্রহীতা গুরুত্বর অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথে ট্রায়াল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো! পরে, ডায়াগনসিসের মাধ্যমে যখন নিশ্চিত হয়েছে – দুজনেরই অসুস্থতার কারণ ভিন্ন, তারপরেই আবার ট্রায়াল চালু করা হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে আরেক টিকার ক্ষেত্রে, সেক্ষেত্রে টিকার নেয়ার পরে একজনের মৃত্যুই ঘটেছিলো। এবং ট্রায়াল বন্ধ ছিল। পরে, যখন নিশ্চিত হয়েছে মৃত্যুর ভিন্ন কারণ ছিলো, তখন আবার ট্রায়াল চালু করা হয়েছে! ফলে, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গুরুতর অসুস্থতা, মৃত্যুর মত ঘটনা একটাও থাকলে টিকা পরের ফেজে যাওয়ার অনুমোদন পাবে না! এখন পর্যন্ত করোনার সব টিকারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হচ্ছে, জ্বর, বাহুতে ব্যাথা, শরীর ব্যথা, অবসন্ন লাগা ইত্যাদি। মডার্ণা, ফাইজারের মত টিকায় রেয়ার কেস পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দেখলাম, হৃৎপিণ্ডে প্রদাহ (ইনফ্লেমেশন) ও ব্লাড ক্লোটিং এবং এগুলোও প্রাণঘাতী ছিল না! ফলে, এই টিকাগুলোর সবই ১৮ উর্ধ্ব মানুষের জন্যে নিরাপদ বলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে জানতে পারছি! সন্দেহ যদি থাকে, তা কার্যকারিতা নিয়ে, মানে কোন কোন টিকা যেমন মডার্ণা ও ফাইজারের টিকা অধিক কার্যকর, সিনোফার্ম, আস্ট্রাজেনিকার টিকা সেই তুলনায় কিছুটা কম কার্যকর। সে জায়গা থেকে বাংলাদেশে এখন সিনোফার্মের যে টিকা দেয়া হচ্ছে, তার সেফটির ব্যাপারেও সন্দেহ কমই বলে মনে করছি!
তাহলে, বাংলাদেশে যে কারো কারো ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তার কারণ কি হতে পারে? আমার মতে সাম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছেঃ
- ১) বাংলাদেশে এখন করোনার সংক্রমণ মারাত্মক অবস্থায় চলে গিয়েছে। গ্রামে গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শুনছি ঘরে ঘরে অসুস্থ মানুষ! ফলে, যে মানুষটি টিকা নিতে যাচ্ছে, হতে পারে সে এর আগেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে!
- ২) এখন যে গণটিকা কর্মসূচির আওতায় একেবারে ওয়ার্ড লেভেলেও টিকা দান চলছে, অনেকজায়গাতেই করোনার উপসর্গ আছে কি নেই সেসব ভালোভাবে দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না! নেদারল্যাণ্ডে টিকা নিতে গিয়ে দেখেছি, রেজিস্ট্রেশনের সময়ে একবার করোনার হিস্টোরি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, এবং টিকা নিতে ঢুকার আগে আরেকবার করোনার কোন রকম উপসর্গ আছে বা ছিল কি না- এ ধরণের একগাদা প্রশ্নের জবাব দিতে হয়! কোন রকম উপসর্গ নিয়ে টিকা নেয়ার স্থানে প্রবেশের স্কোপই নেই! বাংলাদেশে যতখানি শুনলাম, একরকম গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিচ্ছে, সেখানকার কেউ করোনায় আক্রান্ত কি না বা উপসর্গ নিয়ে এসেছে কি না, সে ব্যাপারে তেমন দেখভালও নেই! ফলে, টিকা নিতে যাওয়ার সময়, টিকা কেন্দ্রে এবং টিকা নিয়ে ফিরে আসার সময়েও ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- ৩) অনেকেই মনে করছে, টিকা নেয়ার সাথে সাথেই সে ভাইরাস-প্রুফ হয়ে গিয়েছে। ফলে, টিকা নেয়ার পর মুহুর্ত থেকেই সে ইচ্ছেমত ঘুরেছে, ফিরেছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা ভুলে গিয়েছে! এতে করে, প্রোপার ও পর্যাপ্ত এন্টিবডি তৈরি হওয়ার আগেই কেউ কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে!
আপনার মতামত জানানঃ