অনুপম সৈকত শান্ত
দারুণ উজ্জীবিত শ্রীলংকা এশিয়া কাপের ১৫ তম আসরে ফাইনাল ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে ষষ্ঠ বারের মত চ্যাম্পিয়ান হলো। শ্রীলংকাকে অভিনন্দন! এই ফাইনাল ম্যাচটি ছিল এশিয়া কাপে তাদের ১২ তম ফাইনাল! অথচ বছর কয়েক আগেও শ্রীলংকা দলটাকে বেশ আনকোড়া এক দল মনে হচ্ছিলো, এই আসরের আগের আসর, সেই ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে শ্রীলংকা ফাইনাল তো দূরের কথা, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের কাছে হেরে গ্রুপ পর্যায় থেকেই বিদায় নিয়েছিলো। ওই সময়টিতে বাংলাদেশকে শ্রীলংকার চাইতে শক্তিশালী মনে হচ্ছিলো, ওডিআইয়ে তো বটেই, এমনকি টেস্টেও শ্রীলংকার মাটিতে বাংলাদেশ ১-১ এ সিরিজ ড্র করে এসেছে, শ্রীলংকার মাটিতে টিটুয়েন্টিতে পরপর দু ম্যাচ তাদেরকে হারিয়েছে (২০১৮ সালের নিদহাস ট্রফিতে)! আসন্ন বিশ্বকাপেও যেখানে বাংলাদেশ সরাসরি মূল পর্বে খেলবে, সেখানে শ্রীলংকাকে উৎরাতে হবে বাছাই পর্ব (কেননা নির্দিষ্ট সময়ে আইসিসি র্যাংকিং-এ তারা অনেক পেছনে ছিল)! সেই শ্রীলংকা এই আসরের সেরা দল হিসেবে এশিয়া কাপ জিতলো। আর, হতোদ্যম বাংলাদেশ শতভাগ হারের লজ্জা নিয়ে সবার আগে দেশে ফিরলো! স্বভাবতই আমাদের ক্রিকেট সমর্থকদের মাঝে এখন এই প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরেই আসছেঃ
- শ্রীলংকার ক্রিকেট পারলে, বাংলাদেশের ক্রিকেট কেন পারে না?
- শ্রীলংকার ক্রিকেট গত চার-পাঁচ বছরে যতখানি এগিয়েছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট ১৫-২০ বছরে ততখানি আগায়নি?
- দুই দেশের বোর্ডের অবস্থা কি একই রকম বাজে, দুর্নীতিবাজ ও সমস্যায় ঘেরা না? বরং তাদের বোর্ড তো আমাদের চাইতে দরিদ্র, তার পরেও তারা পারছে কিভাবে?
- তাহলে কি পার্থক্যটা কেবল ক্রিকেটারদের? আমাদের ক্রিকেটারদের ডেডিকেশন ও কমিটমেন্টেই কি ঘাটতি আছে?
এক
শেষ প্রশ্নের জবাব দিয়েই শুরু করি। আমি মনে করি না যে, আমাদের ক্রিকেটের (এবং ক্রিকেটারদের) যাবতীয় ব্যর্থতার মূল বা অন্যতম বড় কারণ আমাদের ক্রিকেটারদের ডেডিকেশন ও কমিটমেন্টের ঘাটতি! বস্তুত ক্রিকেটারদের দায় বা ঘাটতি একদমই নগণ্য। হ্যাঁ তারা ভালো খেলতে পারছে না, তারা জয়ের জন্যে যথেষ্ট স্কিলফুল না। এতটুকুই তাদের দায়, এর বেশি কিছু না! বাংলাদেশের ফুটবলাররা, হকি খেলোয়াড়রা, এথলেটরা, যেকোন খেলার খেলোয়াড়রাই দুনিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিযোগিতা করার মত না। তার জন্যে কারণ বা দায় খেলোয়াড়দের দেয়াই যেতে পারে, কিন্তু সেই দায়টা কেবল এতটুকুই যে- তারা ততটুকু ভালো খেলে না, সেই পরিমাণ স্কিল তাদের নেই। এর বেশি বলার কোন মানে নেই আসলে, ডেডিকেশন, কমিটমেন্ট – এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অবান্তর। এমনকি নিজের জন্যে খেলে, রেকর্ডের জন্যে খেলে- এসবও হাস্যকর অভিযোগ, কেননা যেকোন দলীয় খেলায় অধিকাংশ সময়ই খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত পারফর্মেন্স, রেকর্ড মোটেও দলের পারফর্মেন্স এর সাথে কন্ট্রাডিক্টরি নয়। এবং, খেলোয়াড়দের কেউই আসলে শুধু শুধু হারতে চায় না, দলের জয়ের চাইতে নিজের রেকর্ড বা পারফর্মেন্সকে গুরুত্বও দেয় না সাধারণত! অতএব, যদি কোন খেলায় আমরা সত্যি উন্নতি করতে চাই, তথা পূর্বতন ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে চাই- তাহলে খেলোয়াড়দের দিকে দৃষ্টি দিয়ে কোনদিনই কিছু পাল্টানো সম্ভব হবে বলে মনে করি না! এমনকি যদি ধরেও নেই যে, জাতীয় দলের জার্সি চাপানো এই খেলোয়াড়দের ডেডিকেশন ও কমিটমেন্টের ভয়াবহ ঘাটতি আছে, তাহলেও সেদিকে তাকানোর কিছু নেই, বরং আসল প্রশ্নটা করা উচিৎ- কেন জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের কমিটমেন্ট আর ডেডিকেশনের অভাব, বা কেন কমিটমেন্ট-ডেডিকেশনলেস খেলোয়াড়রা জাতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো করলেই বুঝা যাবে- মূল সমস্যা আসলে কোনদিকে!
দুই
যেকোন খেলায় ভালো করার ক্ষেত্রে খুব জরুরি বিষয়টা হচ্ছে- সেই খেলার সংস্কৃতি আর তার অবকাঠামো। সব ধরণের খেলাতেই আমরা যে এত এত পিছিয়ে আছি, তার প্রধান কারণই হচ্ছে- আমাদের এই সংস্কৃতিটাই গড়ে ওঠেনি, আমাদের খেলাধুলার অবকাঠামোও প্রচণ্ডরকম দুর্বল! শ্রীলংকা পারে আর বাংলাদেশ যে পারে না- তার মূল কারণ দুই দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি আর ক্রিকেট অবকাঠামোর পার্থক্যের মাঝেই পাওয়া যাবে! সংস্কৃতি এক দুই বছরে গড়ে ওঠে না! প্রথমে জানা দরকার- শ্রীলংকা প্রায় সব খেলাতেই বাংলাদেশের চাইতে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ কস্মিনকালেও অলিম্পিকে একটা পদক পর্যন্ত জিততে পারেনি- জেতা তো দূরের কথা মূল পর্বের লড়াইয়েই ঢুকতে পারে না, সেখানে শ্রীলংকা অলিম্পিকে দুটো পদক জিতেছে (দুটোই রৌপ্য)! শুধু অলিম্পিক কেন, কমনওয়েলথ গেমস (শ্রীলংকার ৪ সোনা সহ ২৪ পদক বনাম বাংলাদেশের ২ সোনা সহ ৮ পদক), এশিয়ান গেমস (১১ সোনা সহ ৪৬ পদক বনাম ১ সোনাসহ ১২ পদক) থেকে শুরু করে- সমস্ত জায়গাতেই শ্রীলংকার পদকের সংখ্যা বাংলাদেশের চাইতে বেশি। ফলে, জাতিগতভাবে কিছুই না জেতা, কিছুই না পারার হীনমন্যতা আমাদের চাইতে তাদের তুলনামূলক বেশ কম! তারা ক্রিকেটে ওডিআই বিশ্বকাপ জিতেছে একবার, রানার আপ হয়েছে দুই বার, মোট ৪ বার সেমিতে উঠেছে। টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে একবার, দ্বিতীয়/ রানার আপ হয়েছে ২ বার, ৭ আসরের ৪ বারই সেমিতে খেলেছে, জয়ের হার ৬৩%, যা ভারত, ওয়েস্ট ইণ্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশের চাইতেও বেশি। এশিয়া কাপের ১৫ আসরের মধ্যে ১২ বার ফাইনাল খেলেছে তারা, ৬ বার হয়েছে চ্যাম্পিয়ান (ভারত ১০ বার ফাইনাল খেলেছে, অবশ্য চ্যাম্পিয়ান হয়েছে ৭ বারই)! এশিয়া কাপেও শ্রীলংকার জয়ের হার সবচেয়ে বেশি, ৬৮% (ভারতের ৬৬%)! ফলে, তাদের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে এই জয়ের অভ্যাসটা খুব ভালোভাবেই আছে, কোন পালাবদলে সাময়িক হারে তাদের আত্মবিশ্বাস তাই একেবারে তলানিতে যায় না সহজে!
তিন
শ্রীলংকা চার-পাঁচ বছরে যা পেরেছে বা যতখানি এগিয়েছে, আমরা গত ১৫-২০ বছরেও তা পারিনি? এই আলাপে আমাদের না পারার কথাটা ঠিক, কিন্তু শ্রীলংকা যা পেরেছে বা পারছে বলে মনে করছি- সেটা কি কেবল তাদের চার-পাঁচ বছরের পারা? মোটেও নয়! শ্রীলংকার ক্রিকেট ইতিহাস বেশ পুরাতন। শ্রীলংকা আইসিসির সহযোগী সদস্য হয়েছে ১৯৬৫ সালে আর পূর্ণ সদস্য হয়েছে ১৯৮১ সালে। কিন্তু শ্রীলংকা ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে সেই বৃটিশ আমল থেকেই। শ্রীলংকার ক্রিকেট বোর্ড প্রথম গঠিত হয় ১৯১৪ সালে Ceylon Cricket Association নামে। তার মানে সেখানে ক্রিকেটের পথ চলা শতাব্দীর বেশি সময় ধরে, তাদের ক্রিকেট অবকাঠামো বলি আর সংস্কৃতি বলি- সেটাও শতবছর ধরে গড়ে উঠেছে! শ্রীলংকা পারে, আর বাংলাদেশ পারে না- তার কারণ যদি সত্যি দেখতে চাই, তাহলে এই ক্রিকেট অবকাঠামোর দিকেই আসলে বেশি তাকানো দরকার, তাহলেই বুঝা যাবে- যুব বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার পরেও আমাদের পাইপ লাইনের অবস্থা এত করুণ কেন!
চার
শ্রীলংকার ক্রিকেট অবকাঠামো নিয়ে এর আগে একটি পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম এখানে প্রধান কয়েকটা ব্যাপার পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করছিঃ
- এখন শ্রীলংকায় চলছে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট, মেজর লীগ টুর্ণামেন্ট। সেখানে খেলছে মোট ২৬ টা দল। দুই গ্রুপ বা টায়ারে ভাগ হয়ে ১৩ টা দল একেকটা গ্রুপে খেলছে। দল প্রতি ১৫/১৬ জন করে খেলোয়াড় ধরলে ২৬ দলে প্রায় ৪০০ জন খেলোয়াড় ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলে! ম্যাচের সংখ্যাও বেশি। বাংলাদেশের কতজন খেলোয়াড় ফার্স্ট ক্লাস বা ডিপিএল, বিপিএল খেলার সুযোগ পায়? ৮ দলের এনসিএল-এ ১০০-১২০ জন, আর ৪ দলের বিসিএল-এ খেলতে পারে বড়জোর ৫০-৬০ জন। অনেকেই দল না পেয়ে এদিক ওদিক খ্যাপ খেলতে যায়, কেউবা একাদশে সুযোগ না পেয়ে সাইড বেঞ্চ গরম করে! যারা খেলার সুযোগ পাচ্ছে, তারাই বা সারাবছরে কয়টা করে ম্যাচ খেলতে পারে? গতবছর ঘরোয়ায় কোন ওয়ানডে লীগ/ টুর্নামেন্টই আয়োজন করা হয়নি, টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষে ডিপিএল-কে বানিয়ে দেয়া হলো টিটুয়েন্টি টুর্নামেন্ট! অনেকদিন ওয়ানডে হয় না বিধায় এ বছর বিসিএল ওয়ানডে টুর্নামেন্ট হলো, সেখানে ৪ টা দল সাকুল্যে ৭ টা ম্যাচ খেলেছে (দুটো দলের খেলোয়াড়রা ৩ টি আর অন্য দুই দলের খেলোয়াড়রা ২ টি ম্যাচ খেলেছে!
- শ্রীলংকার এই ২৬ টা দল দুই গ্রুপে যখন খেলে, এক সাথে ১২ টা করে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। তার মানে কমপক্ষে ১২ টা মাঠে খেলা চলছে! আমাদের ৮ দলের এনসিএল আর ৪ দলের বিসিএল এখন পর্যন্ত হোম এণ্ড এওয়ে ভিত্তিক করা সম্ভব হয়নি! গতবছর সিলেটে বিসিএল এর ম্যাচগুলো রাখা হয়েছে, অনুশীলনের জন্যে চারদলকে নির্দিষ্ট সময়ে মাঠ ভাগ করে ব্যবহার করতে হয়েছে, মানে এক দল যখন অনুশীলন করেছে আরেক দলকে বসে থাকতে হয়েছে। ডিপিএল তো ঢাকা কেন্দ্রিক, খেলাগুলো হয় মিরপুর আর বিকেএসপিতে। এরমধ্যে আবার গতবছর মিরপুরের মাঠে কয়েকদিন মুজিববর্ষ পালনের জন্যে খেলা সম্ভব হয়নি- খেলাগুলো হুট করে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে নেয়া হয়েছিলো! বিকেএসপির মাঠে নিয়মিত খেলা হয়- অথচ সেখানে আধুনিক ড্রেইনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা পর্যন্ত হয়নি। বৃষ্টিতে মাঠ ডুবে যাওয়ার ভিডিও মনে হয় ইউটিউবে খুঁজলে পাওয়া যাবে। ফতুল্লা স্টেডিয়াম তো এখন ডোবায় পরিণত হয়েছে, ড্রেইনেজ ব্যবস্থা ঠিক ঠাক করবে কিভাবে- সেটার সমাধানই বের করতে সবাই গলদঘর্ম!
- শ্রীলংকা আয়তনে আমাদের অর্ধেক, জনসংখ্যা অনেক কম (ঢাকা মেট্রোতে যত মানুষ, তার চাইতে কিছু বেশি)। সেখানে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম আছে ৭ টা। রাজধানী কলম্বোতে ৩ টা। বাকিগুলো সারাদেশে ছড়ানো ছিটানো- গল, ক্যাণ্ডির পাল্লেকেলে, ডাম্বুলা, হাম্বানতোতায়। সেগুলোতে নিয়মিত ডমেস্টিক ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের ঘুরেফিরে সেই মিরপুর আর চট্টগ্রামই শেষ কথা। সেই সাথে কদাচিৎ সিলেট। আণ্ডার-১৯ বা নারীদের কিছু খেলা হয় কক্সবাজারে। বহু টাকায় গড়া আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম ফতুল্লা, বগুড়া, খুলনা- এগুলো স্রেফ অনাদর, অবহেলাতেই নষ্ট হয়েছে!
- শ্রীলংকার স্কুল ও বয়সভিত্তিক ক্রিকেটটাও খুব শক্তিশালী। স্কুল ক্রিকেটের জন্যে সেখানে আলাদা একটা এসোসিয়েশনই আছে (স্কুলস ক্রিকেট এসোসিয়েশন শ্রীলংকা -এসএলএসসিএ), যেটাও শুরু হয়েছে ১৯৪৫ সালে। সারাদেশের স্কুল-কলেজের প্রিন্সিপালদের নিয়ে এই এসোসিয়েশনটি গড়ে উঠেছে, যাকে পৃষ্ঠপোষকতা করে দুটো মন্ত্রণালয় (স্পোর্টস মিনিস্ট্রি আর এডুকেশন মিনিস্ট্রি) ও ক্রিকেট বোর্ড। সেখানকার স্কুল ক্রিকেট আর আমাদের স্কুল ক্রিকেটের বড় পার্থক্য হচ্ছে- আমাদের মত উপজেলা- জেলা- বিভাগীয় – জাতীয় পর্যায়ে খেলার মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ান স্কুল বের করা হয়না। বরং সেখানে স্কুল ক্রিকেটটা হয় বয়সভিত্তিক। অনুর্ধ্ব-১৩ পর্যায়ে ৫০০ স্কুল অংশ নেয়, অনুর্ধ্ব-১৫ পর্যায়ে ৩৫০ স্কুল, অনুর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ে ২৫০ টি স্কুল এবং অনুর্ধ্ব-১৯ পর্যায়েও ২৫০ টি স্কুল অংশ নেয়। এই স্কুল ক্রিকেট দারুণ জনপ্রিয়, উৎসবের আমেজে বাচ্চারা খেলে, তাদের মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে খবর ছাপে। আমাদের নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটও অবশ্য একসময় বেশ জমজমাট ছিল!
- শ্রীলংকা ক্রিকেট অবকাঠামো দুনিয়ার একমাত্র (বা আমাদেরকে ধরলে দুই মাত্র) যা ক্লাবভিত্তিক। ফার্স্ট ক্লাস ও লিস্ট এ ক্রিকেট চলে ২৬ টি ক্লাবের মধ্যে। অন্যদিকে আমাদের ক্রিকেট অবকাঠামো- না ক্লাব ভিত্তিক, না আঞ্চলিক, কিংবা আমাদের ক্রিকেট অকাঠামোটা একই সাথে ক্লাব ভিত্তিক ও আঞ্চলিক! এখানে ডিপিএল হয় ক্লাব ভিত্তিক, এনসিএল বিভাগীয় আর ফ্রাঞ্চাইজি বিপিএল হয় আঞ্চলিক। আবার বিসিএল-টা হয় বোর্ডকেন্দ্রিক, এছাড়াও মাঝে মধ্যে কিছু টুর্ণামেন্ট হয় বোর্ড কেন্দ্রিক! অর্থাৎ, আমাদের ক্রিকেট অবকাঠামোর পুরা ব্যাপারটাই হযবরল! শ্রীলংকার ক্লাবভিত্তিক ক্রিকেট অবকাঠামোটা বাংলাদেশের ডিপিএল আসরে যে ক্লাবভিত্তিক অবকাঠামো আছে তার চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। মূল তফাৎ হচ্ছে- আমাদের এই ক্লাব ভিত্তিক অবকাঠামোর পুরোটাই ঢাকাকেন্দ্রিক। শ্রীলংকার ক্লাবভিত্তিক অবকাঠামোতেও কলম্বোর প্রাধান্য বেশি থাকলেও আমাদের মত নয়। তাদের ২৬ ক্লাবের ১২ টি কলম্বো কেন্দ্রিক, বাকিগুলো সারাদেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে! প্রতিটি ক্লাবের নিজস্ব মাঠ, একাডেমি, অনুশীলনের সুযোগ সুবিধা- সবই আছে! জাতীয় দলে ঢুকার আগে খেলোয়াড়রা লম্বা সময় ধরে নিজ অঞ্চলের বয়স ভিত্তিকে ক্রিকেট খেলতে পারে, ক্লাব-একাডেমিতে যুক্ত হতে পারে, তারপরে একসময়ে ক্লাবগুলোতে খেলে! একটা টানা প্রসেসের মধ্যেই থাকতে পারে!
পাঁচ
একটা নবীন দেশের ক্রিকেট অবকাঠামো ও সংস্কৃতি কিভাবে গড়ে উঠে? এক্ষেত্রে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটাই হচ্ছে- ক্রিকেট পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকে তাদের। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করে ক্রিকেট সংগঠকরা এবং ক্রিকেট সংগঠকদের একটা ফর্মাল বডি- বা ক্রিকেট বোর্ড! তো, শ্রীলংকা আর আমাদের ক্রিকেট বোর্ড কি একই রকম? দুটোই কি একই রকম বাজে, জঘণ্য ও দুর্নীতিবাজ? মোটেও নয়! দুটো মোটেও এক নয়। আমাদের বোর্ড অনেক ধনী একটা বোর্ড, সে তুলনায় তাদের বোর্ড বলতে গেলে দরিদ্রই। কিন্তু, ধনী হলেই তো শুধু হয় না! দুই বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে- শ্রীলংকার ক্রিকেট বোর্ডটা চলে ক্রিকেট সংগঠকদের দ্বারা! আর, আমাদের ক্রিকেট বোর্ড চলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কর্তৃক নিযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা! ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে বোর্ডও পাল্টায়। সাবের হোসেন, আসগর লবী, কামাল বা পাপন- কারোরই বোর্ডের দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত ক্রিকেটের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না, না খেলোয়াড় হিসেবে – না সংগঠক হিসেবে। শ্রীলংকায় এমনটা হয় না! সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- বাংলাদেশে একবার সভাপতি হয়ে বসলে সেটা তার বাপ দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি হয়ে যায়, তেমনটা শ্রীলংকায় হয় না। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়! ফলে, রাজনৈতিকভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসার স্কোপ বেশ কম। ক্রিকেট শ্রীলংকার বর্তমান সভাপতি শাম্মি সিলভা একসময় ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন, কলম্বো ক্রিকেট ক্লাবের ক্যাপ্টেনও ছিলেন, তারপরে খেলায় বেশিদূর আগাতে না পেরে, সংগঠক বনে যান, কলম্বোর একটা ক্লাবের চেয়ারম্যান, পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ক্রিকেট শ্রীলংকার আগের মেয়াদের সভাপতি থিলাঙ্গা সুমাথিপালা একজন রাজনীতিবিদ, তিনি সংসদ সদস্য ও স্পিকারও হয়েছিলেন। কিন্তু তারটাও রাজনৈতিক নিয়োগ ছিলো না (এর আগেও তিন দফায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, ১৯৯৭-৯৮, ২০০০-০১ ও ২০০৩-০৪)। শ্রীলংকার বোর্ডে ঘাপলা আছে অনেক, এই যে থিলাঙ্গা, যিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী বোর্ড প্রধান (চারবারের সভাপতি), তার বিরুদ্ধে পর্যন্ত এখন আইসিসি’র এন্টি করাপশন ইউনিট আকু’র তদন্ত চলছে। ২০০৮ সালে লিজেণ্ডারি ক্যাপ্টেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা সিলেকশন প্রসেসে বিতর্কিতভাবে প্রভাব রাখতে গিয়ে পদই হারিয়েছিলেন। চিফ সিলেক্টর, কিউরেটর, কোচিং স্টাফের বিরুদ্ধে আকু’র দুর্নীতির তদন্ত হয়েছে, কারো কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণও হয়েছে। ক্রিকেটারদের সাথেও বোর্ডের নানা সময়ে ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু, এরপরেও স্বাভাবিক-সাধারণ কাজ থেমে থাকেনি। কেননা- তাদের সেই অবকাঠামোটা আছে, যা আপন গতিতে ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যায়! বোর্ডের কাউন্সিলররা সবাই প্রভাবশালী, ফলে কাউকেই বোর্ড প্রধানের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না বা তল্পিবহন করতে হয় না, বরং চাইলে তারা মেয়াদ সম্পন্ন হওয়ার আগেই বোর্ড প্রধানকেই পদচ্যুত করতে পারে (যেমনটি অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে করেছিলো)!
একটা দেশের ক্রিকেট পরিচালনার মূল দায়িত্ব যেহেতু তার বোর্ডের ঘাড়ে ন্যাস্ত, ফলে বোর্ডের গঠন ও গঠন প্রকৃয়া খুবই গুরুত্ব! আর সেখানেই সবচেয়ে বড় তফাৎ দুই দেশের বোর্ডের মধ্যে। আমাদের বোর্ড আজ পর্যন্ত প্রকৃত ক্রিকেট সংগঠকদের আস্তানা হয়ে উঠতে পারেনি! ঢাকাই ক্লাব ক্রিকেটের ব্যবসায়ীদের হাতে এর কলকাঠি, রাজনৈতিক প্রভাব আর মাফিয়া চক্রদের আখড়া এটা। আমাদের লিজেণ্ডারি ক্রিকেটার যারা এখানে যুক্ত হয়েছে- তাদের কাজ হচ্ছে বোর্ডের শোভাবর্ধন, ফলে তারাও একরকম অনুগত এমপ্লয়ীর বেশি কিছু রোল পালন করে না বা করতে পারে না!
ছয়
যেহেতু আমাদের ক্রিকেট বোর্ড ভর্তি এরকম অথর্ব, অযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে, সেহেতু ক্রিকেট অবকাঠামো আর সংস্কৃতিটা গত ২০ বছরেও গড়ে উঠতে পারেনি, এমন বোর্ড থাকলে আগামি ২০ বছরেও গড়ে উঠবে না! তারা কাজের কাজ কিছু করবে না, কিন্তু সবসময় লাইম লাইটে ঠিকই থাকার চেস্টা করবে! সেজন্যে দেখবেন, সবসময় অনেক আওয়াজ করবে। কথায় আছে, শুণ্য কলস বাজে বেশি, আমাদের বোর্ডও শুধু বাজবে বা বাজাবে। কাজ করবে না। দেশের মাঠ – উইকেটের কোন খবর নাই, আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামগুলো একটার পর একটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো বাদ দিয়ে তারা বিশাল জাঁকজমকের নৌকা স্টেডিয়াম বানাতে যাচ্ছে! সপ্তাহে কয়েকবার করে সভাপতি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলবে, দল হারলে কথা বলবে, জিতলে কথা বলবে, খেলোয়াড়কে নিয়ে কথা বলবে, পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবে, কোচকে নিয়ে কথা বলবে। এই করবো- ওই করবো, এই করছি, ওই করছি, বা এই করেছি- ওই করেছি, এসব বাজবে! কখনো পাপন, কখনো জালাল, কখনো আকরাম খান, কখন দুর্জয়, কখনো সুজন। শুধু কথা আর কথা! ফাটা বাঁশের মত বেজেই যায়! কিন্তু, ক্রিকেট অবকাঠামোর কোন পরিবর্তন হয় না! তো- কি এত কথা বলে? কথা বলে, প্লেয়ারদের নিয়ে। অমুক খেলোয়াড় দুর্দান্ত, ওরা ভবিষ্যৎ। না পারলে মুখে রাজ্যের অন্ধকার নিয়ে এসে বলবে- এ বাদ ও বাদ। কোচ বাদ। একে পাল্টাও তাকে পাল্টাও। সেই একই চক্রেই চলছে! কিন্তু, কোন জায়গাটায় আসলে সমস্যা- সেদিকে কারোর কোন দৃষ্টি নেই। আসলে, সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার যোগ্যতাই তো এই বোর্ডের নেই! ফলে, টিম ডিরেক্টর কখনো গিয়ে ছক্কা মারার ক্যাম্প করে। রাতারাতি টিটুয়েন্টি কোচকে বাদ দিয়ে টেকনিকাল কনসাল্টেন্ট নিয়োগ দেয়! এগুলোতে আর যাই হোক, আওয়াজ হয় খুব। সবার মধ্যে ধারণা তৈরি হয়- আমাদের বোর্ড তো ঠিকই খুব চেস্টা করছে।
সব দোষ নন্দ ঘোষের মত তাই কোচ আর ক্রিকেটারদের ঘাড়ে দোষটা দিলে- বোর্ডের মহাতরিমরা বহাল তবিয়তে গদি রক্ষা ঠিকই করে যেতে পারে।
সাত
কিন্তু ক্রিকেটারদের, বিশেষ করে সিনিয়র খেলোয়াড়দের কি কোন দোষ নেই? ক্যাপ্টেনের কোন সমস্যা নেই? হ্যাঁ, আছে। অবশ্যই কোন ম্যাচ বা সিরিজে খারাপ খেললে বা হারলে বা খুব বাজেভাবে হারলে- সেখানে খেলোয়াড়দের বাজে পারফর্মেন্সের দায়, ক্যাপ্টেনের বাজে ক্যাপ্টেন্সির দায়, ক্যাপ্টেন – টিম ম্যানেজমেন্টের ভুল টিম সিলেকশনের দায়, নির্বাচকদের ভুল স্কোয়াড নির্বাচনের দায় থাকে। সেসব নিয়ে অবশ্যই সমালোচনা, কথা বার্তা আলাপ আলোচনা হয়, হবে। সেগুলো ডে টু ডে আলাপ। দুনিয়ার সব দলকে নিয়েই প্রতি ম্যাচ শেষে এরকম আলাপ আলোচনা, তর্ক বিতর্ক সমর্থকরা করে। ভুবি হারালো, রোহিত ক্যাপ্টেন হিসেবে কতটুকু লুথা, নবী বা ফিঞ্চ পারফর্ম না করেও কেন খেলে, রিজওয়ানের স্লো ব্যাটিং এর কারণে পাকিস্তান হারলো, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই আলাপ – সমালোচনা (কিংবা প্রশংসা) আর একটা দলের সমস্যা সংকট ও তার সমাধানের আলাপ এক না। বুঝতে হবে, একটা দল যখন কোন ম্যাচে বা সিরিজে খারাপ করে, তখন তার দায় নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের, ক্যাপ্টেনের, কোচের। যখন একটা দল টানা বা ধারাবাহিকভাবেই খারাপ করতে থাকে, দিনে দিনে তার পারফর্মেন্স এর পারদ নামতেই থাকে, তখন সমস্যাটা কেবল কিছু খেলোয়াড় বা ক্যাপ্টেন-কোচের থাকে না! আর, যখন খেলোয়াড় – ক্যাপ্টেন – কোচ পাল্টানোর পরেও অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না, বা খারাপ খেলোয়াড়কে বাদ দিতে গিয়ে বিকল্প খেলোয়াড় খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয় বা যাদেরকে আনা হয় তারাও খুব জঘণ্য পারফর্ম করতে থাকে, তখন মোটেও সমস্যার আলাপটা কেবল খেলোয়াড়-ক্যাপ্টেন-কোচে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না! একদমই উচিৎ না!
আট
আমাদের খেলোয়াড়দের সমালোচনা হরহামেশাই আমরা করি, সেগুলো তাদের পারফর্মেন্স এর সমালোচনা! এতটুকুই! এর বাইরে তাদেরকে নিয়ে সমালোচনার কিছু নেই। নাঈম শেখ, সাব্বির, রিয়াদ, মুশিকে টিটুয়েন্টি একাদশ তো দূরের কথা- স্কোয়াডেও দেখতে চাই না, কারণ তারা টিটুয়েন্টি ফর্মাটের খেলাটা সেভাবে পারে না বা অনেকদিন ধরে ফর্মে নেই। ওদেরকে নিয়ে সমালোচনাটা এতটুকুই। এরপরের লেভেলে সমালোচনাটা কাদের নিয়ে হবে? তারা যদি স্কোয়াডে ঢুকে তাহলে নির্বাচকদের নিয়ে, একাদশে ঢুকলে- ক্যাপ্টেন, কোচ বা টিম ম্যানেজমেন্টকে নিয়ে। ‘নাঈম কেন একাদশে’- এটা নাঈমের উদ্দেশ্যে সমালোচনা নয়, এই সমালোচনাটা ক্যাপ্টেনের, বা টিম ম্যানেজমেন্টের, আর ‘সে কিভাবে স্কোয়াডে আসে’- এই সমালোচনাটা নির্বাচকদের উদ্দেশ্যে। এখন ক্যাপ্টেন কেন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, ক্যাপ্টেন কেন বাজে, ক্যাপ্টেন কেন পারফর্ম করে না- এরকম প্রশ্ন যখন তৈরি হয়, সেই সমালোচনা কিছু ম্যাচের জন্যে থাকে ক্যাপ্টেনের, কিন্তু ক্যাপ্টেন যখন ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়, তখন সমালোচনাটা আর ক্যাপ্টেনের থাকে না, সমালোচনার তীর চলে যাবে- এই ক্যাপ্টেনকে যারা বহাল রেখেছে তাদের দিকে! নির্বাচকরা ধারাবাহিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত দিলে তখন আর নির্বাচকদের সমালোচনায় সীমাবদ্ধ থাকা যায় না, সেই নির্বাচকরা কিভাবে বহাল আছে, এই সমালোচনার তীর তখন বোর্ডের দিকে যায়! এভাবেই সবকিছুর মূলে কিন্তু সেই বোর্ডকেই পাওয়া যাবে!
নয়
এমনকি খেলোয়াড়, ক্যাপ্টেন, কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচকদের আমরা যখন কড়া সমালোচনা করি, তখনও যদি তাদের পরিস্থিতিটা একটু চিন্তা করি, তাহলে সমালোচনার বদলে মায়াই হবে। আমাদের ব্যাটার-বোলারদের দিনের পর দিন বাজে মাঠে – উইকেটে খেলে খেলে যখন ফ্লাট উইকেটে বড় রান করার বা ডেথ ওভারে বল করার এবিলিটি বা স্কিলই গড়ে ওঠে না, তখন এত কড়া সমালোচনা হয়তো তাদের প্রাপ্য নয় বলেই মনে হয়! আমরা অমুক তমুককে ছেটে ফেলতে চাই। মুশি কেন একাদশে? রিয়াদ কেন? নাঈম কেন? বিজয় কেন? সাব্বির কেন? মুস্তা কেন? শরিফুল কেন? তাসকিন কেন? গত বছরে এরকম সমালোচনার তীর ছিল লিটনের দিকে, শান্তর দিকে, সোহানের দিকে, সৈকতের দিকে। মুনিম এলো, ফেইল করলো। শামিম এসেছিলো, ফেইল করেছে। নাঈম – সাব্বির কোথাও পারফর্ম না করেই কেন এলো, তার জন্যে নির্বাচক- টিম ম্যানেজমেন্টকে সমালোচনা করি ঠিকই, সামনে কোথাও পারফর্ম না করেই সৌম্যকে নিয়ে আসার কথা চলছে- এরও সমালোচনা করছি। কিন্তু, একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়, কেন নির্বাচক – টিম ম্যানেজমেন্ট এরকম করছে! কেননা, তাদের হাতে অপশন একদমই কম! এখন এই যে অপশন এত কম, কেন? পাইপ লাইনের অবস্থা এত খারাপ কেন? তার কারণই হচ্ছে আমাদের ঘরোয়ার অবস্থা খুব বাজে! একেতো খুবই বাজে উইকেটে খেলায় স্কিলের অবস্থার বারোটা। তার উপরে, ঘরোয়াতে পর্যাপ্ত খেলাই হয় না! এক বিপিএল বাদে আর কোন টিটুয়েন্টি টুর্নামেন্ট নেই! বিপিএল এ বিদেশী ওপেনার – টপ অর্ডার ব্যাটারের ভীড়ে আমাদের ওপেনাররা খেলার সুযোগই পায়নি। নাঈম, সাব্বির, ইমনরা সুযোগ পায়নি! সুযোগ পাওয়াদের মাঝে মুনিম – বিজয় ভালো করায় জাতীয় তাদের নিয়ে এসেছে, কিন্তু তারাও ফেইল করেছে। তাহলে উপায় কি? ব্যাটিং অর্ডারের ৩-৪-৫ থেকে সাকিব – মুশি – রিয়াদকে সরাতে চাই। মুশি তো চলেই গেলো, ধরলাম রিয়াদও গেলো, সাকিবকেও আটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। তিন – চার – পাঁচে আফিফ – রাব্বি – সৈকত (ছয়ে সোহান)কে নিলাম। এখন আফিফ, রাব্বি, সৈকত, সোহানের ব্যাকাপ কে? তাদের কেউ যদি ইনজুরিতে পড়ে, তাদের জায়গায় খেলানোর মত অপশন কি আছে? বাধ্য হয়েই তখন সাকিব, রিয়াদের কথা ভাবতে হয়, বা কোথাও পারফর্ম না করা সৌম্য-সাব্বিরকে ফেরাতে হয়! শামিম – মুনিমরা যে জাতীয় দলে এসে পারফর্ম করতে পারলো না, তার দায়ও কি কেবল তাদের? ঘরোয়ায় ভালো করার পরে সরাসরি জাতীয় দলে চলে আসলে এরকমই তো হওয়ার কথা! এ দল, ইমার্জিং দলের খেলা কোথায়? তাহলে, এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় তারা তো বাজে খেলবেই!
দশ
তাহলে কি দাঁড়ালো? আমাদের স্কুল ক্রিকেটের ফর্মাট ঠিক নেই। ভালো একাডেমি নেই। অনুর্ধ্ব-১৯ খেলা ছেলেরা ঘরোয়ায় গ্রুমিং হওয়ার প্রোপার সুযোগ পায় না! দুই একজন ঝলক দেখালে ডিরেক্ট জাতীয় দলে ঠিকই ঢুকে যায়, একদম অপ্রস্তুত অবস্থাতেই! এ দল বা ইমার্জিং দল নিয়ে কোন ধারাবাহিক প্লান পরিকল্পনা নাই। মাঠ নেই, উইকেট এর অবস্থা জঘণ্য! লিটন দাস সাহস নিয়ে সেদিন সাক্ষাৎকারে বললো- মিরপুরে খেললে, অনুশীলন করলে অবস্থা আরও খারাপ হবে! স্কোয়াড/ একাদশ নির্বাচন হয় খুব জঘণ্যভাবে। দিনের পর দিন বাজে কিপিং করার পরেও স্কোয়াডে থাকা বা একাদশে কিপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বা ফর্মহীন সিনিয়র খেলোয়াড়দের বহন করার দায় কি ক্রিকেটারদের? এরকম জঘণ্য অবকাঠামো আর চরম অব্যবস্থাপনার পরেও আমাদের ক্রিকেটাররাই সাউথ আফ্রিকায় ওডিআই সিরিজ জিতিয়ে আসলো, নিউজিল্যাণ্ডে টেস্ট জিতলো! ওডিআই সুপার লীগে আমরা এখন সেকেণ্ড পজিশনে! এগুলো কিভাবে সম্ভব হলো, সেটাই বরং বড় প্রশ্ন হওয়া উচিৎ! এই সফলতার জন্যে কখনো বোর্ড, কখনো প্রধানমন্ত্রীর দোয়া আবার কখনো টিম ডিরেক্টর সব ক্রেডিট পকেটে ঢুকায়! কিন্তু ক্রেডিট তো আমাদের এই ক্রিকেটারদেরই, নয় কি? এক বা দুজন নয়, বরং অনেকের অবদান সে ম্যাচগুলোতে পাওয়া যাবে! আমাদের নারী ক্রিকেটারেরা তো বোর্ডের সৎ কন্যা, কোন রকম খেলাধুলার মধ্যেই থাকে না, আইসিসি/ এসিসির ইভেন্ট থাকলে তারা খেলার সুযোগ পায়। ঘরোয়ায় একই মাঠে পুরুষদের সেকেণ্ড ডিভিশনের খেলার জন্যে মাঠের অভাবে তাদের নির্ধারিত লীগই পিছিয়ে যায়। সেই মেয়েরাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ট্রফি, এশিয়া কাপ এনে দিয়েছে! আমাদের স্কুল ক্রিকেটে বয়সভিত্তিক শক্ত অবকাঠামো না থাকার পরেও যুবারাই তো বিশ্বকাপ জেতালো! ফলে, ডেডিকেশন নাই – কমিটমেন্ট নাই, এরকম গ্রস অভিযোগগুলো খুবই অন্যায্য! বরং, এই যে চরম জঘণ্য একটা ক্রিকেট অবকাঠামোর মধ্য থেকেও তারা যতটুকু ডেলিভার করছে, তার জন্যে আসলেই তাদেরকে মাথায় তুলে রাখা উচিৎ, নয় কি?
আপনার মতামত জানানঃ