ড্রোন প্রযুক্তির এমন অনেক ব্যবহার আছে, যা মানুষের কল্পনাশক্তির বাইরে; যার মধ্যে আছে আবহাওয়ার পরিবর্তনও। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিজ্ঞানীরা ড্রোনের মাধ্যমে মেঘে আঘাত করে ইলেকট্রিক্যাল চার্জ ব্যবহার করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের পরিকল্পনা করেছে— ‘ক্লাউড সিডিং’ এর সফলতার উপর ভিত্তি করেই এই প্রক্রিয়াটি দাঁড় করানো হয়েছে।
অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মতোই সংযুক্ত আরব আমিরাতে অত্যধিক তাপমাত্রা ও শুষ্কতা জীবনকে দুর্বিষহ করে রেখেছে। ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে দেশটিতে মাত্র ১.২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে; যেখানে গ্রীষ্মে তাপমাত্রা প্রায়ই ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে ফেলে। একারণে বিজ্ঞানীরা এই চরম তাপমাত্রা, তাপপ্রবাহ, পানির সংকট ও বাতাসের নিম্নমানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সমাধানের চেষ্টা করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মেঘ থেকে বৃষ্টি নানোর যে প্রচেষ্টা দেশটি গ্রহণ করেছে তা শুধু তাদের নিজেদের নয় বরং মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পানির সংকট সমাধানে দারুণ ভূমিকা রাখবে।
‘এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ; শুধু বৈজ্ঞানিক বা গবেষণায় পরীক্ষার ক্ষেত্রে নয় বরং ক্লাউড সিডিং এর ক্ষেত্রে বৈশ্বিক কেন্দ্র হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও’, ২০০৭-২০০৮ ক্লাউড সিডিং ফ্যাসিলিটি স্টাডিজে অংশগ্রহণ করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ড. মোহাম্মেদ শামরুখ আরব নিউজকে বলেন। তিনি মনে করেন, এই অঞ্চলের জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত দরকারি।
বিশ্বের অন্যতন শুষ্ক দেশ হিসেবে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের অল্প কিছু সুপেয় পানির নিজস্ব উৎস আছে। যার ফলে দেশটির অর্থনীতি বিশালভাবে আমদানি এবং নির্লবণীকরণের উপর নির্ভর করে। নির্লবণীকরণ বলতে সমুদ্রের পানি থেকে লবণ আলাদা করাকে বোঝার। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে এবং কৃষিকাজের জন্য যা দেশটিতে অপরিহার্য।
মূলত পৃথিবীর সমুদ্রের পানির ১৪ শতাংশই সংযুক্ত আরব আমিরাতে লবণমুক্ত করা হয়। সৌদি আরবের পরেই তাদের অবস্থান— সৌদিও ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তিকে সুপেয় পানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করছে। রিয়াদ গত বছর একটি ক্লাউড সিডিং প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে যার মাধ্যমে দেশটির বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আরব আমিরাত যদিও আরও আগেই এমন প্রকল্প হাতে নিয়েছে; ২০১৭ সালে দেশটির সরকার নয়টি বৃষ্টি বর্ধন প্রকল্পে ১৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল।
পরীক্ষামূলক ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা পুঞ্জিভূত মেঘে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মানব-সৃষ্ট প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে এমন ছোট, দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত ইঞ্জিনবিহীন বিমান ব্যবহার করা হবে; যা ইলেকট্রিক-চার্জ নিঃসরণ যন্ত্র দ্বারা সজ্জিত থাকবে এবং বেশ নিচুতে উড়ে বাতাসের অনুগুলোতে ইলেকট্রিক চার্জ প্রদানে সক্ষম হবে।
মেঘ সাধারণত পজেটিভ এবং নেগেটিভ চার্জ বহন করে, কিন্তু এই চার্জগুলোতে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এই ইলেকট্রিক শক পানির বিন্দুগুলোকে আরও বড় বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত করে এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়।
অবশ্যই বৃষ্টিপাত হবার পর, এই পানিকে সমুদ্রে মেশা থেকে বিরত রাখাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এজন্য আরব আমিরাত ১৩০ টি ড্যাম ও বাঁধ নির্মান করেছে; যার ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১২০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার।
বিজ্ঞানীরা মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত ঘটানোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদ্ধতি খুঁটিয়ে দেখছে; যার মধ্যে আছে লবণের মিশ্রণ, সিলভার আয়োডাইড এবং শুষ্ক বরফ বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে দেয়া।
যদি ড্রোনের এই প্রক্রিয়াটি সফল হয়, সামনের বছরগুলোতে এই অঞ্চলের সুপেয় পানির সরবরাহ ঠিক রাখতে ক্লাউড সিডিং বড় ভূমিকা রাখতে চলেছে। বৃষ্টি বর্ধন প্রোজেক্ট সফল হলে, দেশের খরা প্রতিরোধও সহজ হবে।
পৃথিবীর ৭১ শতাংশ পানি। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘ অনুযায়ী, এই অঞ্চলই পৃথিবীতে সবথেকে বেশি পানির সংকটে ভুগছে; যেখানে ১৭ টি দেশ পানির ক্ষেত্রে দরিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে।
পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, দুর্বল অবকাঠামো এবং সীমিত সম্পদের অতিমাত্রায় ব্যবহার। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এই অঞ্চলে শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রেই ৮০ শতাংশ পানি ব্যবহৃত হয়।
এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের অর্থ এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভূ-গর্ভস্থ পানির সঞ্চয় চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহারের পর পূর্বাবস্থায় ফিরছে না অর্থাৎ সঞ্চয় কমছে। সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করা এবং ড্যামই এক্ষেত্রে সমাধানের পথ; যদিও এগুলো ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। এর প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। খরায় জীবিকা ধ্বংস হচ্ছে, মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিচ্ছে; যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
বিশ্বে প্রায় ১.১ বিলিয়ন মানুষ ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির অভাবে আছে এবং ২.৭ বিলিয়ন মানুষ বছরে অন্তত এক মাস পানির অভাবে থাকে। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ পানির অভাবে ভুগবে।
পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালে পানির সরবরাহ নাটকীয়ভাবে কমে যাবে এবং পানির ক্ষেত্রেও রেশন ব্যবস্থা হয়তো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে যদি না উপযুক্ত কোন সমাধান পাওয়া না যায়।
গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রায় ২০০ ক্লাউড সিডিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিল দেশটির ন্যাশনাল সেন্টার অব মিটিওরোলজি ও সেইসমোলজি (এনসিএমএস)।
আরব আমিরাত ২০০৬ সালে বিরলভাবে অতিবৃষ্টিতে ভুগলেও, মূলত বছরের পুরো সময় জুড়েই শুষ্ক থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন অবস্থাকে আরব আমিরাত এবং এর প্রতিবেশী দেশগুলোর পানির সংকটকে চরম রূপ দিয়েছে।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত জানে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার গুরত্ব, দুবাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব বায়োস্যালাইনের হাইড্রোজিওলজি এবং ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের অধ্যক্ষ ও বিজ্ঞানী ড. খালিল আমার বলেন। তিনি আরও বলেন, তারা জানে কোন মেঘে তাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে; যাতে বন্যা বা ভূমির ক্ষতি হবে না।
ক্লাউড সিডিং এমন এক বিজ্ঞান যা খুব দ্রুতই নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে; সংযুক্ত আরব আমিরাতও এর সুবিধা নিতে প্রস্তুত। যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা আরও স্বাভাবিক দুর্যোগ হয়ে উঠবে, তখন বৃষ্টির পরিমাণ বা বিতরণ নির্ধারণের ক্ষমতা উপসাগরীয় এবং অত্র অঞ্চলে আরব আমিরাতকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে। একারণে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির জন্য আরও বেশি গবেষণা এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে যেতে হবে, আমার বলেন।
যাই হোক, কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাতের প্রাকৃতিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য ঝুঁকি নিয়েও ভাবতে হবে বিজ্ঞানীদের; যার মধ্যে আছে দুর্যোগ ও বন্যা।
আমার বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত এমন মেঘ এড়িয়ে যায় যা প্রচুর বৃষ্টিপাতে সক্ষম। আমাদের এই প্রকল্পের খুঁটিনাটি; কী ঘটছে, কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, অর্জন কী— এসবের প্রমাণ সামনে আনতে হবে। যে পরিমাণ বৃষ্টিই আপনি নামান, তার গুরুত্ব অসীম; কারণ তা দেশ এবং ওই অঞ্চলের পানির সরবরাহে যুক্ত হবে।’
শামরুখের মতে, আরও অনেক দূর যেতে হবে; সিডিং প্রযুক্তি এবং প্রক্রিয়াটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আরও ভালো করে বোঝার ক্ষেত্রে। বর্তমানে অনেক ক্লাউড সিডিং প্রক্রিয়া আছে।
শাহরুখ এবং আমির দু’জনেই বৃষ্টি বর্ধন প্রযুক্তিতে আরও বেশি বিনিয়োগ আশা করছেন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানির সংকটে পারস্পরিক আঞ্চলিক সহায়তাও প্রত্যাশা করছেন তারা।
আমার বলেন, ক্লাউড সিডিং অবশ্যই দরকারি, বিকল্প নয়। বিজ্ঞানীদের উচিত নতুন গবেষনা চালিয়ে যাওয়া। সমগ্র জিসিসি-এর জন্য যৌথ প্রোগ্রামও সম্ভব; আলাদা কাজ করার থেকে, নিজেদের অবস্থার উন্নয়নে একত্রে কাজ করাটাই লাভজনক। তিনি বলেন, বৃষ্টি খুবই মূল্যবান। কারণ বৃষ্টি ছাড়া দেশগুলো টিকে থাকতে পারবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২১২
আপনার মতামত জানানঃ