ঝালকাঠি সদর উপজেলার একটি মাদ্রাসায় মাদ্রাসাশিক্ষকের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোয় ১০ ছাত্রকে বেত্রাঘাত করে আহত করেছেন এক শিক্ষক। এ ঘটনায় গতকাল শনিবার রাতে সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের কে এ খান হাফেজি মাদ্রাসার অভিযুক্ত শিক্ষককে এলাকাবাসী পুলিশে সোপর্দ করেন।
পরে ওই দিন রাতেই নির্যাতনের শিকার আমিনুল ইসলাম (১১) নামের এক শিক্ষার্থীর বাবা মো. শামীম খলিফা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ সেই মামলায় অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, করোনাকালীন সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে কে এ খান হাফেজী মাদ্রাসা খোলা রেখে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছিলেন শিক্ষক মোহাম্মদ উল্লাহ। শনিবার বেলা ৩টার দিকে ৯ থেকে ১০ বছর বয়সী ১৩ জন শিক্ষার্থী মাদ্রাসার ভেতরে খেলছিল।
তাদের কথার শব্দে মোহাম্মদ উল্লাহর ঘুম ভেঙে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মাদ্রাসার একটি কক্ষের দরজা আটকে ১০ ছাত্রকে বেত দিয়ে পিটিয়ে জখম করেন তিনি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মারধরের পর ওই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কক্ষে আটকে রেখে বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দেন। মারধরের বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতিও দেখান তিনি।
পরে মাগরিবের নামাজের সময় কৌশলে ৯ বছর বয়সী একটি শিশু পালিয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্থানীয়দের বিষয়টি জানায়। শিশুটি পালিয়ে যাওয়ার পর শিক্ষক মোহাম্মদ উল্লাহ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মো. মোরশেদ খানকে ঘটনাটি জানিয়ে দ্রুত সব শিক্ষার্থীকে বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন।
ঘটনাটি জানার পর পোনাবালিয়া বাজারের শতাধিক বাসিন্দা মাদ্রাসা ঘেরাও করে শিক্ষককে আটক করেন। পরে তাকে ঝালকাঠি সদর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
স্থানীয়রা মারধরে আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে পল্লি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসা নেয়ার পর ৯ জন বাড়িতে চলে গেছে। শিশু সিয়ামের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মারধরের পর ওই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কক্ষে আটকে রেখে বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দেন। মারধরের বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতিও দেখান তিনি।
খবর পেয়ে রাতেই ঝালকাঠি সদর থানা-পুলিশ ওই মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষক উল্লাহকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খলিলুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগে এক অভিভাবক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। এই মামলায় অভিযুক্ত শিক্ষককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আজ রোববার তাকে আদালতে নেওয়া হবে।
আইন কী বলছে?
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷ শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
এতে বলা হয়, হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টারজাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা উঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্রে শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। এ কারণে তারা শিশুদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটা জানে না। আর মাদ্রাসায় যেসব অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায় তারাও সচেতন না। এ কারণে নির্যাতন হলেও তারা তেমন কিছু বলে না। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ছাত্র নির্যাতনের একটি পরিবেশ অনেক দিন থেকেই চলে আসছে।’
এভাবে পেটানোর পেছনে শিক্ষকদের মানসিকতাই দায়ী বলেও মনে করেন তারা। বলেন, ‘মনে হয় ছাত্র নির্যাতনে তারা একধরনের আনন্দ অনুভব করেন। এটা অবশ্যই একটা মানসিক বিষয়।’
এর সমাধান বিষয়ে বলেন, ‘সমাধান হলো যারা সেখানে ছেলে-মেয়ে দেবে তারা যেন সচেতন হয়। অভিভাবক বলবে কোনোভাবেই যেন এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন না চালানো হয়। সেই সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন।’
তারা বলেন, ‘‘এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার দর্শন অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি৷ নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত৷ কেউ কেউ মনেই করেন কিছুটা মারপিট সুশিক্ষার জন্য দরকার আছে৷ আর কওমী মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই তাই তারা সরকারের নির্দেশও মানতে চায় না৷’’
আরও বলেন, ‘‘ওস্তাদের মার খেলে ওই জায়গাটা বেহেশতে যায়— এটা যদি হয় চিন্তা তাহলে মারপিট থামবে কীভাবে? সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিশুদের বলাৎকার করেও কেউ কেউ রেহাই পেয়ে যান৷
অবশ্য শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হলে, তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে হবে৷ সেটা যেমন স্কুলে তেমনি তার ঘরে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৪
আপনার মতামত জানানঃ