রেকর্ড বৃষ্টিপাতের পর গত মাসে ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ বন্যা। এতে জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ডে প্রাণ হারান অন্তত শ’ দুয়েক মানুষ। তার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলে শুরু দিয়েছে সর্বগ্রাসী দাবানল। দাউদাউ করে জ্বলছে তুরস্ক, গ্রিস, ইতালি, নর্থ ম্যাসিডোনিয়া, অ্যালবেনিয়ার মতো দেশগুলো। ইউরোপের সাথে পাল্লা দিয়ে দাবানল বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রেও।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস জানিয়েছে, গত জুলাই ছিল ইউরোপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উষ্ণ মাস। এই তাপপ্রবাহ চলবে আগস্টেও। সেই সঙ্গে দাবানলে পুড়তে পারে দেশগুলো।
খবর অনুসারে, তুরস্ক ও গ্রিসে ইতোমধ্যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে দাবানল। ইতালিতেও ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। সিসিলিসহ দেশটির অন্তত তিনটি অঞ্চলে দাবানলের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। চলছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল।
গ্রিসের দাবানল
গ্রিসে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রচণ্ড তাপদাহ চলছে। ১৯৮৭ সালের পর সেখানে এত গরম আর কখনো পড়েনি। তাপমাত্রার পারদ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। এই অবস্থা চলবে অন্তত আগামী রোববার পর্যন্ত।
গত বুধবার থেকে গ্রিসে ১০০টির বেশি জায়গায় দাবানল চলছে। এথেন্সের শহরতলিতে দাবানল পৌঁছে গেছে। অলিম্পিয়ার স্মৃতিস্তম্ভের কাছেও আগুন চলে গেছিল। দেশটির ছয়টি অঞ্চলে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। দাবানলে এখন পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে দাবানল। ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে এ অঞ্চল। সেখান থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। কাছেই অবস্থিত এভিয়া দ্বীপেও আগুন জ্বলছে। দ্বীপের বাসিন্দা এবং পর্যটকদের মাছধরা নৌকা ও ফেরিতে করে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
গ্রিসজুড়ে ১৫৪টি দাবানল নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছেন শত শত অগ্নিনির্বাপণকর্মী। স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে রাতদিন কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন গ্রিসের নাগরিক নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী নিকোস হার্দালিয়াস। প্রায় ২০টি উড়োজাহাজ থেকে ছিটানো হচ্ছে পানি। ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশও বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। দেশগুলো থেকে পাঠানো হচ্ছে আরও অগ্নিনির্বাপণকর্মী ও উড়োজাহাজ।
আতঙ্কে তুরস্ক
দক্ষিণ তুরস্কে শুরু হওয়া দাবানল ১১ দিন পার করছে। এর মধ্যে ৪৭ প্রদেশের ২০৯টি দাবানলের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এর বিপরীতে পাঁচ প্রদেশে ১৩টি দাবানল এখনো জ্বলছে।
গত ২৮ জুলাই দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের আনতালিয়া থেকে দাবানলের সূচনার পর এই পর্যন্ত মোট আটজনের প্রাণহানী হয়েছে। দাবানলের আগুন নেভানোর জন্য আজারবাইজান, ইরান, কাজাখস্তান, রাশিয়া ও ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশ সরঞ্জাম ও লোকবল দিয়ে সহায়তা করেছে।
এদিকে ২১৮ ঘণ্টা চেষ্টার পর আনতালিয়া প্রদেশের মানাভগাত ও গুনদোমুশ জেলার দাবানলের আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছেন দমকলকর্মীরা।
শুক্রবার মানাভগাতে দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (এএফএডি) সমন্বয় কেন্দ্রে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মওলুদ চাভুশওলু।
তিনি বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বাতাসের প্রচণ্ড গতি সত্ত্বেও দমকল কর্মীরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানসমূহ থেকে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, এক হাজার নয় শ’ ১৫ দমকল বিভাগের বাহন ও আট হাজার এক শ’ ৫৫ দমকল কর্মী আগুন নেভানোতে অংশ নেয়। অপরদিকে তুর্কি বিমান বাহিনী আগুন নেভানোর জন্য এক হাজার ছয় শ’ বার অভিযান চালায়।
ইতালিতে দাবানল
এদিকে ইতালির সিসিলিতে প্রথম দাবানল শুরু হয়েছিল। এখন তা ইতালির বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানেই দমকল এবং বিমানের সাহায্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে আগুন আয়ত্ত্বে আনা যাচ্ছে না। দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে পুরো বন। ধ্বংস হচ্ছে ঘরবাড়ি। হাজার হাজার মানুষ পালাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে দাবানলে শতাধিক বাড়ি পুড়ে গেছে। তিন সপ্তাহ চলতে থাকা ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম এই দাবানলে আরো ক্ষতি করতে পারে বলে জানা গেছে।
ডিক্সি দাবানল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই অগ্নিকাণ্ড চার লাখ ৩২ হাজার আট শ’ ১৩ একর সমপরিমাণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে দাবানলের কারণে এখনো কোনো ব্যক্তির হতাহত হওয়ার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের খবরে কিছু জানানো হয়নি।
এদিকে প্লুমাসের ন্যাশনাল ফরেস্ট সুপারভাইজার ক্রিস কার্লটন স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যে, তাদের কাছাকাছি কোথাও ধোঁয়া দেখা গেলেও তারা যাতে বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নেন।
তিনি বলেন, ‘যদি কোনো সতর্ক বার্তা আপনি নাও শুনেন তবুও আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হবে।’
এর আগে গত ১৩ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ার ক্রেস্টা বাঁধের কাছে পর্যটন কেন্দ্র ফেদার নদীর গিড়িখাতের সড়ক থেকে দাবানলের সূচনা হয়। ডিক্সি সড়ক নামের পরিচিত এই সড়ক থেকেই ভয়াবহ এই দাবানলটি পরিচিতি পেয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে ধনী দেশগুলোকেই দায় নিতে হবে
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন) নিঃসরণ। ফলে, দুনিয়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি দশকই দেখা যাচ্ছে আগের দশকের চেয়ে উষ্ণ।
দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি কার্বন উদ্গিরণ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো। এর এক নম্বরে রয়েছে চীন ও তার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুনিয়ার জলবায়ুর এমন পরিবর্তন হয়েছে যে এখনই পরিবেশদূষণ বন্ধ হলেও জলবায়ুর পরিবর্তন চলতেই থাকবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। আলাদাভাবে প্রতিটি দেশ এমন একটা পথ বের করার ওপর জোর দেবে, যাতে করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারে।
তারা বলেন, একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৫
আপনার মতামত জানানঃ