বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বিভিন্ন দেশে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকির মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সম্প্রতি বন্যার মাত্রা যেন তীব্র আকার ধারণ করেছে। আগের সংখ্যার তুলনায় বর্তমানে ১০ গুণ বেশি মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। খবর এএফপি
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের গবেষক ও বন্যা বিশ্লেষণভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্লাউড টু স্ট্রিটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বেথ টেলম্যান জানান, আগের সংখ্যার তুলনায় বর্তমানে ১০ গুণ বেশি মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত, চীন, জার্মানি ও বেলজিয়ামসহ ইউরোপে ভয়াবহ বন্যার দেখা দিয়েছে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গবেষণাটি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী বন্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোয় বসবাসরত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৮ কোটি ৬০ লাখ।
সাধারণত দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখা হয়। তবে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বন্যার পরিমাণ বাড়ছে। আশঙ্কা করা হয়েছে, ভবিষ্যতে আফ্রিকায় বন্যার কারণে প্রতিবছর ২৭ লাখ মানুষ ভিটেমাটি হারাবে। এ কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে সেখানকার সাড়ে আট কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে এ বিষয়ে গবেষকেরা বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন।
তারা জানান, ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ২২ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২৯ কোটি মানুষ।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক কারণে বন্যাকবলিত এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে ৮ কোটি ৬০ লাখ মানুষ।
কম্পিউটারভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া তথ্যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের ভৌগোলিক স্থানান্তরের কারণে আরও ২৫টি দেশ বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী বন্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোয় বসবাসরত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৮ কোটি ৬০ লাখ।
গবেষণা দলের প্রধান এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের গবেষক বেথ টেলম্যান এএফপিকে জানান, গত ২০ বছরে নতুনভাবে বন্যাকবলিত অঞ্চলের আওতায় আসা মানুষের বন্যার ঝুঁকি আগের তুলনায় ১০ গুণ বেড়েছে। বাঁধ ভেঙে বন্যার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি।
টেলম্যান বলেন, বাঁধে ভাঙন বা বাঁধ উপচে পড়ার ১৩টি ঘটনায় প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বায়ুমণ্ডল প্রায় সাত শতাংশ বেশি আর্দ্রতা শোষণ করতে পারে। উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট এই অতিরিক্ত আর্দ্রতা দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চতর পরিমাণে বৃষ্টিপাত বা বিশেষত ভারী বৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। আলাদাভাবে প্রতিটি দেশ এমন একটা পথ বের করার ওপর জোর দেবে, যাতে করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারে।
তারা বলেন, একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
তারা বলেন, যেসব প্রযুক্তি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড অপসারণ করে অথবা পৃথিবী থেকে দূরে সূর্যালোকের প্রতিফলন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, সেসব নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও নিয়ন্ত্রণ ত্বরান্বিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার এ ধরনের সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি এখনো অপ্রমাণিত ও তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু কোভিড মোকাবিলায় আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতাকে যদি কোনো সূচক হিসেবে ধরি, তাহলে দেরি না করে সেই সূচকগুলো তাড়াতাড়ি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হওয়াটাই ভালো। বিশ্বায়ন থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এখানে একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশ্বায়ন ব্যবস্থাপনার কোন উপায় আমরা বেছে নেব।
আপনার মতামত জানানঃ