আখাউড়া-সিলেট মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর প্রকল্পের দায়িত্বে ছিল চীনা ঠিকাদার। তবে ব্যয় কমানোর কারণে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এতে অনিশ্চয়তায় পড়েছে প্রকল্পটি। এ কারণে ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও কাজের অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এদিকে, ভারত অর্থায়নের প্রস্তাব দিলেও চীনের দিকেও তাকিয়ে থাকবে কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্প বিভ্রাট
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জি টু জি ভিত্তিতে এ প্রকল্পে চীনের ঠিকাদার কাজ পায়। কিন্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করা এক তদন্তে প্রকল্পে বেশি ব্যয় ধরার তথ্য উঠে আসে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা কমানো হলে এ প্রকল্পে অর্থায়ন ও নির্মাণ কাজ করবে না বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানিয়ে দেয় চীন।
এদিকে চীনের অর্থায়ন ফেরতের সুযোগ কাজে লাগাতে চায় ভারত। এ লক্ষ্যে ভারত তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের (ইরকন) মাধ্যমে কাজ পাওয়া সাপেক্ষে অর্থায়ন নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছে। সম্প্রতি রেলমন্ত্রী মোঃ নূরুল ইসলাম সুজনকে লেখা একটি চিঠিতে ইরকন এ প্রস্তাব দেয়। চিঠিতে ইরকন জানায়, তারা ভারতের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইচ্ছুক।
তবে রেলপথ মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ভারতীয় প্রস্তাব নিয়ে এখনই ভাবছে না এবং চীনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে চায়। চীনকে যদি আর ফেরানো না যায়, সেক্ষেত্রে ভারত, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) বিকল্প উৎস হতে পারে। আর এ অর্থায়নের উৎস নিশ্চিত করবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনও জানান, আখাউড়া-সিলেট রেল প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন-২) ড. মোঃ খালেদ হোসেন বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থায়নের বিষয়টি দেখবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তবে চীনের অর্থায়নের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থায়নের উৎস খুঁজে বের করতে ইআরডিকে চিঠি দেওয়া হবে। তখনই জানা যাবে অর্থায়নে কারা এগিয়ে আসবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মিরানা মাখরুখ বলেন, আখাউড়া-সিলেট প্রকল্প থেকে চীনের ফেরত যাওয়ার বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। চীন পরিবর্তীত প্রস্তাব পাঠাতে বলেছে। যদিও রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে এখনও তা ইআরডিতে পাঠানো হয়নি। এছাড়া ভারতের এক্সিম ব্যাংকের প্রস্তাবের বিষয়েও রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে ইআরডিতে কিছু জানানো হয়নি।
চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে উদ্ভুদ্ধ সমস্যা
সংশ্লিষ্টরা জানান, জি টু জি পদ্ধতিতে চীনের অর্থায়নে প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি হয়। এক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্রও হয়। একইভাবে ভারতের অর্থায়নের প্রকল্পে শুধুমাত্র ভারতীয় ঠিকাদার অংশ নিতে পারে। আখাউড়া-সিলেট প্রকল্পে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী ইরকনই ঠিকাদার হিসেবে কাজ করবে।
এর আগে ভারতের অর্থায়নে বাংলাদেশে চলমান ও বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভারতীয় ঠিকাদার কাজ শুরু করতে বিলম্ব করে। রেলের বিভিন্ন প্রকল্পে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের প্রমাণ রয়েছে। এছাড়া কখনো কোনো অভিযোগ ভারতীয় ঠিকাদার আমলে নেয় না বলেও রেলওয়ের একাধিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে এডিবি, জাইকা বিশ্বব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ঠিকাদার দরপত্রে অংশ নিতে পারে। এতে কাজের মানও ভাল হয়।
প্রকল্পের শুরুতেও ব্যয় নিয়ে ছিল প্রশ্ন
আখাউড়া-সিলেট রেল লাইনকে মিটার গেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরের প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয় ২০১৮ সালের শুরুর দিকে। ওই সময় ২৩৯ কিলোমিটারের মিটার গেজ রেললাইনকে ব্রড গেজে রূপান্তরের ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।
সমজাতীয় প্রকল্পের সঙ্গে ব্যয় পর্যালোচনায় ওই সময় প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রকল্পে ব্যালাস্ট (পাথর), স্লিপার, রেলসহ অন্যান্য উপকরণের পরিমাণ ও ব্যয় চলমান সমজাতীয় অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি।
সব মিলিয়ে প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় সমজাতীয় চারটি প্রকল্পের তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি। এত ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সমীচীন হবে না বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
ওই সময় প্রস্তাবিত প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৫৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অন্যদিকে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরে চলমান প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা ঢালারপর পর্যন্ত নতুন রেলপথ।
এছাড়া মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল আরেকটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণে ব্যয় মাত্র ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
প্রকল্পের ভৌত কাজের জন্য প্রতিযোগিতা ছাড়া এক ঠিকাদারের মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতেও পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি জানিয়েছিল। কমিশনের মতে, চীনের অন্যান্য দরদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্যও দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ওই প্রকল্পে অনেক বেশি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়। এ কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত চীনের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বাতিলের সিদ্ধান্তও নিয়েছিল।
পরিকল্পনা কমিশন আরও বলেছিল, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ডুয়েলগেজ লাইন হলে ট্রেন চলাচলের হার (ফ্রিকোয়েন্সি) বাড়বে না। এ রুটে ডাবল লাইন এবং ডুয়েলগেজ নির্মাণ করা হলে এ প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে। অন্যথায় সরকারের এ বিশাল বিনিয়োগে জনগণের তেমন কোনো সুবিধা হবে না।
স্বয়ং তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এ প্রকল্পে আপত্তি তুলে এক চিঠিতে বলেছিলেন, এটা ডাবল লাইন ও ডুয়েলগেজ হওয়া উচিত। শুধু ডুয়েলগেজ করে কোনো লাভ হবে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তিতে ওই সময় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয়নি। তবে নতুন সরকার এবং অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রী পরিবর্তিত হলে এক বছর পর ২০১৯ সালের এপ্রিলে ১৬,১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১০৩
আপনার মতামত জানানঃ