চট্টগ্রামের পটিয়ায় হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর সমর্থিত এক ছাত্রলীগ নেতা দাবিদারের ‘টিকাবাণিজ্য’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন এবং বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থের বিনিময়ে ৭০০ টিকা প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। খোদ হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নিজের ইউনিয়ন শোভনদন্ডীতে ঘটেছে এই ঘটনা।
হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর প্রভাবে চাকরি পাওয়া মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) রবিউল হুসাইনের বিরুদ্ধে উঠেছে এই অভিযোগ। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে শনিবার বিকালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির।
টিকা নিরাপত্তার ‘কোল্ড বক্স’ ছাড়াই টিকা স্থানান্তর, রেজিস্ট্রেশন কার্ড জালিয়াতিসহ সরকারি তদন্তে ধরা পড়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ‘হুইপ বাহিনীর’ করা টিকা বাণিজ্য। তবে উপজেলার সরকারি টিকা সংরক্ষণাগারের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে।
তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা জানান, অনুমতি ছাড়া ও যথাযথ নিয়ম না মেনে দেওয়া হয় ২৬শ’ টিকা। দুইদিনে দেওয়া ২৬শ’ টিকার উপস্থাপিত রেজিস্ট্রেশন কার্ডের মধ্যে অন্তত ২২শ’ কার্ডই ভুয়া। অনুমতি ছাড়াই এই টিকাদান প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য সহকারীর মতোই হুইপ সামশুলের ভাই মহব্বত নিজেই টিকা পুশ করেছেন টিকা প্রত্যাশীদের। সব মিলিয়ে হইপ পোষ্য-বাহিনীর দ্বারা ভয়াবহ ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে পটিয়ায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালকের নির্দেশে গত শনিবার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। দুই দিন তদন্তের সময় দিয়ে গঠিত এ কমিটি তদন্তকাজ শেষ করে সোমবার সন্ধ্যায় পরিচালক বরাবরে রিপোর্ট জমা দেন। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ডা. অজয় দাশ তদন্ত রিপোর্টের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করলেও একপর্যায়ে স্বীকার করেছেন ‘তদন্তকালে টিকাদান প্রক্রিয়ার অসঙ্গতি ধরা পড়েছে’।
তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমনটি জানালেও তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে বের হয়ে আসে তদন্তে উঠে আসা পটিয়ায় হুইপ বাহিনীর টিকা বাণিজ্যের ঘোরতর অনিয়মের চিত্র।
কী আছে সরকারি তদন্তে?
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে ও নিয়মবহির্ভূতভাবে পটিয়ার শোভনদন্ডী ইউনিয়নে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির বাড়ি লাগোয়া একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে আলোচ্য টিকাগুলো দেওয়া হয়। তদন্তকালে অভিযুক্ত হইপ পোষ্য কথিত ছাত্রলীগ নেতা ও ইপিআই কর্মসূচির টেকনোলজিস্ট রবিউল হুসাইন তদন্ত টিমকে মোট ২৬ শ টিকার রেজিস্ট্রেশন কার্ড উপস্থাপন করেন। কার্ডগুলো সংশ্লিষ্ট বারকোড পরখ করে দেখা যায়, দুই শতাধিক কার্ড পুরনো রেজিস্ট্রেশনকৃত। দুই হাজারের বেশি কার্ড রেজিস্ট্রেশনের জন্য এর পূর্বে আইডি কার্ড নিয়ে আসা মানুষের। আর তাদের নামে রেজিস্ট্রেশন কার্ড রবিবার সকালেই পূরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, পুরনো জমে থাকা আইডি কার্ড দিয়েই তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শনের আগে এসব রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণ করা হয়।
রাষ্ট্রীয় অপচয়
রেখে যাওয়া আইডি কার্ড দিয়ে রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণ করা এই প্রায় ২ হাজার মানুষ পরবর্তী সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে যখন রেজিস্ট্রেশন করতে আসবেন, তখন পরিস্থিতিটা কেমন দাঁড়াবে, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। তখন তাদের জ্ঞাতসারে আবার রেজিস্ট্রেশন হলে তাদের নামে আবার টিকা কি বরাদ্দ হবে? এ ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির নামে সরকারি টিকা দ্বিগুণ বরাদ্দ কি রাষ্ট্রীয় অপচয় হবে না?- এমন প্রশ্নও ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।
শুক্র ও শনিবার দুই দিনেই একটি ইউনিয়ন পর্যায়ের ক্যাম্পে এতগুলো টিকা প্রদানের ঘটনা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে তদন্ত কমিটির কাছে। গণমাধ্যমের এক প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটির প্রধান তা স্বীকারও করেন।
সরকারি একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিভাগের টিকাদান প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল সর্বোচ্চ জনবল দিয়ে পরিচালিত হয়। অথচ এখানেও দুই দিনে শোভনদন্ডী ইউনিয়নের সেই ক্যাম্পটির মতো এত বেশি গতিতে টিকা প্রদান সম্ভব হয়নি। ওই ক্যাম্পে দুই দিনে ২৬০০ টিকা প্রদানের ঘটনা একেবারেই অস্বাভাবিক। তা ছাড়া ক্যাম্পটিতে কোনো ইপিআই প্রশিক্ষিত লোকবলও ছিল না।
স্থানীয় সূত্রের ধারণা, প্রশিক্ষণহীন উপজেলার সুইপার তথা ঝাড়ুদার পর্যায়ের লোকজন দিয়ে এই টিকা প্রদান করা হয়ে থাকতে পারে। এদিকে, ঘটনাস্থলে হুইপ সামশুলের ভাই মহব্বত টিকা দিচ্ছেন এমন ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিও কর্তৃপক্ষকে কম-বেশি উদ্বিগ্ন করছে।
টিকা নিরাপত্তার ‘কোল্ড বক্স’ ছাড়াই টিকা স্থানান্তর, রেজিস্ট্রেশন কার্ড জালিয়াতিসহ সরকারি তদন্তে ধরা পড়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ‘হুইপ বাহিনীর’ করা টিকা বাণিজ্য। তবে উপজেলার সরকারি টিকা সংরক্ষণাগারের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে।
সরকারি অভিন্ন সূত্র জানায়, সাধারণত সিভিল সার্জন অফিস থেকে উপজেলা পর্যায়ে স্থানান্তর করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইপিআই টিকা সংরক্ষণাগারের ফ্রিজেই টিকা সংরক্ষণ করা হয়। সেখান থেকেই কোনো ইউনিয়ন বা ক্যাম্প পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ভ্যাকসিন ক্যারিয়ারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শোভনদন্ডী ইউনিয়নে হুইপের বাড়ি লাগোয়া ওই ক্যাম্পে টিকা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত রবিউল এই ক্ষেত্রে কোল্ড বক্সে টিকা নিয়ে যাননি। এমন অভিযোগ উঠলে তদন্তদলের কর্মকর্তারা উপজেলার ওই সংরক্ষণাগারের সিসি ফুটেজ খোঁজ করতে গিয়ে অবাক হন! তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবারের পরে ওই সিসি ক্যামেরার কোনো ফুটেজের হদিশ পাননি।
সরকারি নির্ভরযোগ্য সূত্রটি আরো জানায়, উপজেলার হেল্থ কমপ্লেক্সেই পূর্ণ লোকবল নিয়ে গোটা দিনে (সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত) মাত্র চার শ থেকে পাঁচ শ টিকা দৈনিক প্রদান করার সক্ষমতা আছে। সেখানে একটি ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত লোকবল ছাড়া কিভাবে দুই দিনে ২৬০০ অর্থাৎ দিনে ১৩০০ করে টিকা প্রদান করা হলো এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
টিকার বদলে অন্য কিছু নাতো?
এলাকার সচেতন ও সাধারণ মানুষের অনেকের মুখে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তারা বলছেন, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে ওই টিকা নিয়ে যাওয়ার পরে তা কি আদৌ কোনো ফ্রিজ বা কোল্ড বক্সে ঠিক মাত্রায় রক্ষিত ছিল? যদি না থাকে তবে সেই অরক্ষিত টিকা কিভাবে এলাকার জনগণকে দেওয়া হলো! নাকি সেই টিকা অন্য কারো হাতে চলে গেছে? বা অন্য কোথাও মজুদ বা বিক্রি হয়েছে? টিকার বদলে সাধারণ মানুষকে সাদা পানি বা অন্যকিছু দেওয়া হয়েছে?
‘হুইপ বাহিনীর’ টিকাবাণিজ্যে তোলপাড়
জানা যায়, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি এলাকার জনগণকে করোনার টিকা দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পর তার নির্দেশনায় ৩০ জুলাই সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত ১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ড রশিদাবাদ আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ৩১ জুলাই সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ড ও ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জনগণের জন্য মহাজন হাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ আয়োজন করা হয়।
শোভনদন্ডী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে টিকা প্রদানের জন্য প্রচারণা চালিয়ে এই সময় ও তারিখে ইউনিয়নবাসীকে (৩০ বছরের ঊর্ধ্বে) আইডি কার্ড সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রে আসার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রশিদাবাদ আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে জড়ো হয় টিকা গ্রহীতারা।
টিকাদানের ঘটনায় অভিযুক্ত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) রবিউল হোসেন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, স্থানীয় হুইপ, চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যরা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন। টিকা দেওয়ার বিষয়টি আমি সবাইকে জানিয়েছি। হুইপ মহোদয় এ বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ বলেন, টিকা দেওয়ার বিষয়ে সরকারি কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। ঘটনাটি জানার পর আসলেই টিকাদান করা হচ্ছে কিনা- তা যাচাই করতে সেখানে গিয়ে সত্যতা পেয়েছি।
এদিকে সরকার গ্রামাঞ্চলে ৭ আগস্ট থেকে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর তার আগেই পটিয়ায় টিকাদান নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। হুইপ সামশুল হক চৌধুরী নিজেকে বাঁচাতে সব দায় রবিউল হোসেনের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। অথচ সম্মতি পাওয়ার পর ব্যানারে ছাপানো হয়েছে তার ছবিও।
প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণকৃত স্থিরচিত্রে দেখা যায়, রশিদাবাদ আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যকর্মীর ভূমিকায় সিরিঞ্জ হাতে হুইপের ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মহব্বত টিকাদান করছেন। প্রশিক্ষিতস্বাস্থ্যকর্মী কিংবা দায়িত্বশীল কেউ না হয়েও তিনি কিভাবে এই দায়িত্ব নিলেন- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন টিকাগ্রহীতা ওই দৈনিককে বলেন, রবিউলসহ কয়েকজন ব্যক্তি টিকা পুশ করেছেন। এদের মধ্যে ফজলুল হক মহব্বতও মানুষকে টিকা দেওয়ার কাজে জড়িত ছিলেন। এসব টিকা যথাযথভাবে সংরক্ষণও করা হয়নি। টিকা নেওয়ার পর কারও বাহুতে ব্যথা বা টিকা দেওয়ার স্থানে ফুলে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৪
আপনার মতামত জানানঃ