করোনা ভাইরাসের কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত ধসে গেছে। ২০১৯ সালে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই খাতের অবদান ছিল ১২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা এখন অনেক কমেছে। ফলে বৈদেশিক বিনিময়ে প্রতিনিয়ত মান হারাচ্ছে দেশটির মুদ্রা রুপি। এতে মুদ্রা ও রিজার্ভ সংকটে ভুগছে শ্রীলংকা। পরিস্থিতি সামলাতে বাণিজ্য নীতিতে পরিবর্তন এনেছে কলম্বো। নিষিদ্ধ করা হয়েছে বেশকিছু পণ্যের আমদানি।
তবে অনেকটাই অপরিকল্পিত ও লক্ষ্যহীনভাবে প্রয়োগকৃত নতুন এ আমদানি নীতি কোনো সুফলই বয়ে আনতে পারেনি এখনো। বরং অর্থনীতির ক্ষত দিন দিন আরো বড় হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে কৃষি পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি খাতই এখন ধুঁকছে শ্রীলংকায়।
আমদানি সংকোচনের প্রভাব
গত বছরের মার্চের দিকে প্রথম আমদানি সংকোচন করতে শুরু করে এখন দেশটিতে আমদানি নিষিদ্ধের তালিকা বেশ বড়। এ তালিকায় মোটরযান, এয়ারকন্ডিশনার থেকে শুরু করে পানীয়, বস্ত্র, কসমেটিকস এমনকি হলুদের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলাও রয়েছে।
দেশটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে সেখানে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ওয়াশিং মেশিনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধেরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আমদানির এ বড় মাত্রার সংকোচনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির ব্যক্তি খাত। ভোক্তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠানই। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোরই ব্যবসা এখন পুরোপুরি বন্ধ।
মহামারীর কারণে অর্থনীতিতে ধস নামলে সঞ্চিতির দ্রুত পতন কমাতে আমদানিতে লাগাম টানা শুরু করে শ্রীলংকা সরকার। দিনে দিনে এ লাগাম আরো শক্ত হয়েছে, যার ক্ষত বইতে হচ্ছে দেশটির ব্যক্তি খাতকে। এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিতেও বাধ্য হয়েছেন। লংকান ব্যবসায়ীরা এখন দেশটির জন্য কোভিডের চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন আমদানি নিষিদ্ধের নীতিকে। আমদানি নিষিদ্ধের কারণে বিপদে পড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতেও ব্যর্থ হয়েছে শ্রীলংকার সরকার।
তবে এ আমদানি নিষিদ্ধের কারণে শ্রীলংকায় সেকেন্ডহ্যান্ড পণ্যের বাজার এখন আকাশচুম্বী। বৈধভাবে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটিতে এখন বেশকিছু পণ্যের কালোবাজারির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থায়ও কালোবাজারই এখন সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউএ বিজয়বর্ধন।
শ্রীলঙ্কার জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় পড়েছে দেশটির কৃষি খাত। সার ও কৃষি রাসায়নিক আমদানি নিষিদ্ধ করার কারণে বিপাকে পড়েছেন শ্রীলংকার কৃষকরা। এ বিষয়ে কলম্বোর যুক্তি হলো প্রতি বছর দেশটিকে এসব কৃষি উপকরণ আমদানিতে ৪০ কোটি ডলারেরও বেশি ব্যয় করতে হয়। তবে এ উদ্যোগের কারণে দেশটির কৃষি রফতানি খাতও ভুগতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সংকট মোকাবেলায় কৃষকদের এখন অর্গানিক সার উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও গোটা প্রক্রিয়াটিই বেশ সময়সাপেক্ষ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মহামারির কারণে অর্থনীতিতে ধস
মহামারি গত বছর শ্রীলংকার অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। পণ্য বাণিজ্যের বাইরে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হলো এ পর্যটন খাত। বিভিন্ন উৎসে পাওয়া তথ্য বলছে, গত বছর খাতটি থেকে শ্রীলংকার আয় হয়েছে মোটে ৯৬ কোটি ডলার। যেখানে আগের বছরও খাতটি থেকে ৩৬০ কোটি ডলার আয় করেছিল দেশটি।
মহামারির অভিঘাতে ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ সংকটকে আরো জোরালো করে তুলেছে মুদ্রা ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও খুব একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে নেই।
গত মাসের শেষে দেশটির রিজার্ভের ব্যাপ্তি ছিল ৪ বিলিয়ন (৪০০ কোটি) ডলার। নিকট অতীতে রিজার্ভের এত বড় সংকটে পড়েনি শ্রীলংকা। বর্তমানে এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার নিয়েছে। শ্রীলংকার মুদ্রা, পুঁজিবাজার ও সরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অজিত নিভারদ কাবরাল জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক একটি সভরেন বন্ড বাবদ প্রদেয় ১০০ কোটি ডলার পরিশোধের পর ওইদিন দেশটির রিজার্ভের আকার ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে সংকট কাটানোর চেষ্টা করেও পারছে না। চলতি বছরের শুরুর দিকে চীনের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ১৫০ কোটি ডলার সংগ্রহ করে শ্রীলংকা। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ২৫ কোটি ও ভারতের সঙ্গে ৪০ কোটি ডলারের সোয়াপ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় এ অংক খুবই সামান্য।
ঋণের ফাঁদে শ্রীলঙ্কা
দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে থাকা শ্রীলঙ্কা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিদেশি ঋণের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এমন একটি পরিস্থিতিতে, ১৯৯৭ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যায় দেশটির। ফলে অর্থের জন্য অন্য উৎসের খোঁজ করতে হয় তাদের।
একটা দেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কতো শতাংশ হারে ঋণ নিতে পারবে তা নির্ভর করে দেশটির অর্থনীতির শক্তিমত্তার উপর। মানে দেশটি যে ঠিকঠাকমত ঋণ ফেরত দিতে পারবে তার গ্যারান্টি কেমন তার উপর। ঋণের এই রিস্ক এসেসমেন্টের জন্য বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত কিছু ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আছে যারা দেশগুলোকে বিভিন্ন মানদন্ডের উপর রেটিং করে। যদি রেটিং ভালো হয় তবে কম সুদেই বড় ঋণ পাওয়া যাবে।
২০২০ সালে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর প্রায় সবগুলোই শ্রীলংকার রেটিং কমিয়ে দেয়। স্টান্ডার্ড এবং পুওর B- থেকে CCC+, মুডিস দুই ধাপ নামিয়ে Caa1, ফিচ B- থেকে চ্চচ নামিয়ে দেয়। এই সবগুলোর রেটিংই শ্রীলংকার অর্থনীতির নাজুক অবস্থা, সীমিত অর্থসংস্থানের উৎস এবং দূর্বল আর্থিক খাতকেই তুলে ধরে। তাছাড়া এমার্জিং বন্ড মার্কেট ইনডেক্সে শ্রীলংকার ঋণ ২০২০ সালের ৫১৭ থেকে বেড়ে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে ১৯৭৫ পয়েন্টে পৌঁছায়। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর এই নেতিবাচক রেটিং এর কারণে আন্তর্জাতিক মার্কেট থেকে শ্রীলংকার ঋণ নেওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে পড়ে।
কিন্তু এই সংকটের শুরু হয় আরো আগে। ২০০৭ সালে, শ্রীলঙ্কা প্রথমবারের মতো ইন্টারন্যাশনাল সভরেন বন্ড (আইএসবি) ছাড়ে, যার মূল্য ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার। ধীরে ধীরে দেশটি বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের এই চ্যানেলটির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে শুরু করে। আইএসবিগুলোর ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পাঁচ থেকে ১০ বছর। ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত কোনো গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যায়না এবং সুদের হার ছয় শতাংশের বেশি।
এ ছাড়া, এখানে ঋণের আসল পরিশোধের বিষয় রয়েছে। কোনো আইএসবির মোট ধার করা পরিমাণ, বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময়ে একবারে নিষ্পত্তি করতে হয়। সহজ শর্তের ঋণের মতো বছরের পর বছর ধরে পরিশোধের সময় থাকে না। তাই, যখন কোনো আইএসবির মেয়াদ পূর্ণ হয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের শেষের দিকে, সভরেন বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া ঋণ শ্রীলঙ্কার মোট বকেয়া বৈদেশিক ঋণের ৫০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়া দেশটির সরকার যদি কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোর সমাধান করতে পারতো, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২১৫
আপনার মতামত জানানঃ