বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো ভ্যাকসিনের জন্য পদদলনের শিকার হতে পারে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর আগে সতর্ক করে দিয়েছিল। সেই কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, ভ্যাকসিন বৈষম্যের কারণে বিশ্ব নৈতিকতার বিপর্যয়কর ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
শুক্রবার(৩০ জুলাই) জেনেভায় বৈশ্বিক কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে এক আলোচনায় তিনি এই মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেছেন, তবুও বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন বিতরণ অন্যায্য থেকে গেছে। সব অঞ্চলই ঝুঁকিতে আছে, কিন্তু কেউই আফ্রিকার মতো বেশি ঝুঁকিতে নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রধান বলেছেন, আফ্রিকার অনেক দেশ টিকাদান কার্যক্রম শুরু করার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত থাকলেও তাদের কাছে এখনও টিকা পৌঁছায়নি। বিশ্বজুড়ে যত ভ্যাকসিন ডোজ এখন পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়েছে, তার মধ্যে ২ শতাংশেরও কম হয়েছে আফ্রিকায়। এই অঞ্চলের দেড় শতাংশেরও কম মানুষ ভ্যাকসিন ডোজ সম্পূর্ণ করেছেন।
টেড্রোস আধানম বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ মোকাবিলায় পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিনের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য র্যাপিড অ্যাক্ট— এক্সেলেটর ডেল্টা রেসপন্স (রাডার) তহবিলে জরুরি ভিত্তিতে ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে।
তিনি বলেছেন, বিশ্বের নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহকারী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগ কোভ্যাক্সের আরও অতিরিক্ত তহবিল দরকার। বিশ্ব এই বিনিয়োগ করার সামর্থ্য রাখে কি-না প্রশ্ন সেটি নয়, বরং এটি না করতে পারার সামর্থ্য আছে কি-না; সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, মহামারির অবসান ঘটবে তখন, বিশ্ব যখন এটিকে শেষ করতে চাইবে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের অতি-সংক্রামক ধরন ডেল্টার প্রকোপ চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলেছে, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট জলবসন্তের মতোই সংক্রামক; টিকা নেওয়া লোকজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর টিকা না নেওয়া লোকজনের মাঝে এটি ছড়াতে পারেন।
করোনা নিয়ন্ত্রণে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিশ্বের সব দেশে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে চাইছে ডব্লিউএইচও। এ বছরেই দেশগুলোতে ৪০ শতাংশ এবং ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ৭০ মানুষকে টিকা দেওয়ার আশা করছে সংস্থাটি। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ দূরে আছে বলে উল্লেখ করেছেন তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস।
মহামারির অবসান ঘটবে তখন, বিশ্ব যখন এটিকে শেষ করতে চাইবে।
এএফপির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৪০০ কোটির বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। তবে এর বেশির ভাগই পেয়েছে উচ্চ আয়ের দেশগুলো। উন্নত এ দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জনে ৯৮ ডোজ টিকা পেয়েছেন। অন্যদিকে, নিম্ন আয়ের ২৯টি দেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ৬ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। আয়ের ভিত্তিতে দেশগুলোর শ্রেণিবিভাগ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। দেশগুলোর মধ্যে টিকাদানের এই অসমতাকে ‘নৈতিক অনাচার’ বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ডেল্টার মতো আরও ভয়াবহ ধরন আসার আগেই বাগে আনতে হবে করোনা
নতুন কোনো ধরন আসার আগেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গতকাল শুক্রবার সংস্থাটি জানায়, করোনার ডেল্টা ধরন একটি সতর্কবার্তা। ডেল্টার ধরনের ভয়াবহতা থেকে বোঝা যায়, সামনের দিনগুলোয় করোনার আরও ভয়াবহ ধরন ছড়িয়ে পড়তে পারে। খবর এএফপির।
মহামারি শুরুর পর থেকে করোনার ধরনগুলোর মধ্যে ডেল্টা সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এটি আগের যেকোনো ধরনের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৩২ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া এ ধরন।
এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি বিভাগের প্রধান মাইকেল রায়ান বলেন, ‘ডেল্টা একটা সতর্কবার্তা। আরও ভয়াবহ ধরন আসার আগে আমাদের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এটি একটি ইশারাও।’
ডেল্টা ধরনের ভয়াবহতা অনেক বেশি হলেও তা নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরিধান ও বারবার হাত ধোয়ার মতো বিষয়গুলো এখনো কার্যকর বলে জানিয়েছেন মাইকেল রায়ান।
তিনি বলেন, ‘এই সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। টিকা নেওয়া থাকলে এগুলো আরও কার্যকর হচ্ছে।’
মাইকেল রায়ান আরও বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া আগের পদক্ষেপগুলো এখনো কার্যকর আছে। তবে এখন সেগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে।
চার সপ্তাহে বিশ্বে সংক্রমণ বেড়েছে ৮০ শতাংশ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ছয়টি অঞ্চলের মধ্যে পাঁচটি অঞ্চলে গত চার সপ্তাহে সংক্রমণ গড়ে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে এই সংক্রমণ লাফিয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ডব্লিউএইচও’র জরুরি বিভাগের প্রধান মাইকেল রায়ান এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এটির আরও বিপজ্জনক মিউটেশনের আগে এখন আমাদের আরও জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।’
রায়ান জোর দিয়ে বলেন, ‘গেম প্ল্যান’ হিসেবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং টিকাদান এখনো কার্যকর উপায়।
অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় চীন ও অস্ট্রেলিয়ায় শনিবার কোভিড-১৯ বিধিনিষেধে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
ভাইরাস আরও প্রাণঘাতী এবং মহামারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে দ্রুত এর মিউটেশন প্রতিরোধে বিশ্বের প্রতি ডব্লিউএইচও’র আহ্বানের পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
কয়েক মাসের মধ্যে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় শনিবার আরও দু’টি এলাকা- ফুজিয়ান প্রদেশ এবং মেগাসিটি চংকিংয়ে সংক্রমণ ছড়িয়েছে।
নানজিয়াং সিটিতে একটি ডেল্টা ক্লাস্টার সংক্রমণ থেকে দুইশ’রও বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নয়জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। শনিবার সংক্রমণ বেইজিং, চংকিং এবং আরও পাঁচটি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
করোনার ডেল্টা ধরন শিশুদের আক্রমণ করে না
করোনাভাইরাসের অতিসংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গত শুক্রবার এমনটাই জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(ডব্লিউএইচও)।
শুক্রবার (৩০ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির করোনা টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান মারিয়া ভ্যান কারখোভ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ছড়িয়ে পড়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, যারা সামাজিকভাবে অন্যদের সংস্পর্শে গেছেন তাদের মধ্যে বেশি ছড়াচ্ছে এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘একটা বিষয়ে আমাদের সবার পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার, তা হলো— ডেল্টা ধরন শিশুদের বিশেষভাবে টার্গেট করে না। কিন্তু যারা করোনা টিকার ডোজ নেননি বা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব ঠিকমতো মেনে চলেন না, তাদের ডেল্টায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।’
মারিয়া ভ্যান কারখোভ আরও বলেন, আমরা দেখছি যে যারা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত তারা খুব একটা পাত্তা দেন না সচেতনতার বিষয়গুলোকে। ঘরের ভেতরে ও বাইরে সচেতন না থাকায়, সামাজিক দূরত্ব না মানায়, লোক সমাগম বেশি হওয়ায় এটি দ্রুত ছড়াচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে স্কুলগুলো চালু করা হলে কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করা যায় তার একটা পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। তবে তার আগে কমিউনিটির মধ্যে সংক্রমণ কমানোর তাগিদ দেয় তারা।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বের ১৩২টি দেশে শনাক্ত হয়েছে। এটি করোনার আগের ধরনগুলোর চেয়ে অধিক সংক্রামক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৪
আপনার মতামত জানানঃ