উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে ইকুয়েডর। ইকুয়েডরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জকে পাঠানো এক চিঠিতে নাগরিকত্ব বাতিলের কথা জানিয়েছে দেশটির বিচার ব্যবস্থা।
গত সোমবার (২৬ জুলাই) ইকুয়েডরের পিচিনচা আদালতে নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে কারাবন্দী রয়েছেন অ্যাসেঞ্জ। এদিকে, এই মাসের শুরুতে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো যাবে না এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারকে আপিল করার অনুমতিও দিয়েছে যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালত।
যা বলছে আদালত
সূত্র মতে, সাধারণত প্রাসঙ্গিক তথ্য গোপন, মিথ্যা নথিপত্র জমাদান কিংবা জালিয়াতির অভিযোগে নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুসারে, অ্যাসেঞ্জের নাগরিকত্ব আবেদনে একাধিক ‘অসঙ্গতি’ পাওয়া গেছে। একাধিক ভিন্ন স্বাক্ষর, নথিপত্র পরিবর্তনের সম্ভাবনা এবং ফি পরিশোধ না করাসহ আবেদনে বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে, অ্যাসেঞ্জের আইনজীবী কার্লোস পোভেদার অভিযোগ, যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, অ্যাসেঞ্জকে বিচারকালে হাজির হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
অ্যাসেঞ্জকে যে তারিখে আদালতে ডাকা হয়েছিল তখন তিনি মুক্ত ছিলেন না, পাশাপাশি বন্দি অবস্থায় অসুস্থ ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন পোভেদা।
নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্তের বিস্তারিত এবং স্পষ্ট ব্যখ্যা জানতে চেয়ে আদালতে আপিল আবেদন করবেন বলে জানান এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, জাতীয়তার থেকেও এখানে অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে ইকুয়েডরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করেছে এবং এই মামলায় যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে; যা কিনা বিগত সরকারের সময়ে শুরু হয়েছিল।
অ্যাসেঞ্জের বিরুদ্ধে ইকুয়েডরের অভিযোগ
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ইকুয়েডরের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ। যুক্তরাজ্যের আপত্তিতে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে ইকুয়েডর। সুইডেনে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ থেকে বাঁচতে ২০১২ সালে পালিয়ে আসেন অ্যাসেঞ্জ। পরবর্তীতে ইকুয়েডর দূতাবাসে সাত বছর ধরে ছিলেন তিনি। দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে সুইডেন অ্যাসেঞ্জের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের তদন্ত বাতিল করে।
৫০ বছর বয়সী অ্যাসেঞ্জ বর্তমানে কড়া নিরাপত্তার মাঝে লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারে আছেন। অ্যাসেঞ্জ গত ২ বছর ব্রিটেনের কারাগারে আছেন। ২০১৯ সালে মোরেনোর সরকার অ্যাসেঞ্জের আশ্রিত পদমর্যাদা বাতিল করে। এরপর এপ্রিলে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। অ্যাসেঞ্জের ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করছিল ইকুয়েডরের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের উপর; যা ইতিমধ্যেই আর নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, আসাঞ্জকে রাখা বাবদ প্রতি বছর ইকুয়েডর সরকারের খরচ হচ্ছিল আনুমানিক এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার! ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং দৈনন্দিন প্রটোকল লঙ্ঘনের’ কারণে তার অ্যাসাইলাম বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা গত জুন মাসে গণমাধম্যে ছড়িয়ে পড়ে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনোর ভাষ্যে।
প্রেসিডেন্ট মোরেনো বলেন, ‘‘আমরা এই স্পয়েলড ব্র্যাট, অর্থাৎ বখে যাওয়া ছেলের রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিল করছি৷’’ এর কারণ আসাঞ্জের বিভিন্ন উদ্ভট অভ্যাস৷ আসাঞ্জ নাকি মধ্যরাতে দূতাবাসের ভেতর সশব্দে স্কেটবোর্ডিং করতেন৷
এছাড়া, তার বিরুদ্ধে ছিল দূতাবাসের কর্মীদের শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ৷ এত টাকা খরচ করে যে অতিথিকে রাখছিল ইকুয়েডর সরকার, সেই দেশের দূতাবাসের দেওয়ালেই নাকি নিজের মল-মূত্র ছড়াতেন এই ইন্টারনেট-সৈনিক! ইকুয়েডরের দূতাবাস আয়তনে খুব একটা বড় না হলেও একটি অফিসঘরকে সাজানো হয় আসাঞ্জের শয়নকক্ষ হিসাবে৷ কিন্তু দূতাবাসের ভেতর ধীরে ধীরে পালটাতে থাকে আসাঞ্জের ব্যবহার৷
দূতাবাসের কর্মীরা বলছেন, প্রায়ই নাকি নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতেন আসাঞ্জ৷ স্নান করতেন না মাসের পর মাস৷ মধ্যরাতে স্কেটবোর্ডিং করার পাশাপাশি জোরে জোরে গানও চালাতেন তিনি, যা একটি দূতাবাসের জন্য বেমানান৷
আসাঞ্জের আচরণকে দূতাবাসের ভেতর অনেকেই দেখতেন ‘ইকুয়েডরের লজ্জা’ হিসাবে৷ ফলে, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন শুধু আন্তর্জাতিক চাপে নয়, আসাঞ্জের অভদ্র আচরণের কারণেও ইকুয়েডর বাতিল করেছে তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন৷ সাথে, জুটেছে ‘বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অতিথি’ হবার বদনামও৷
সূত্র মতে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করার জন্য বিখ্যাত আসাঞ্জ ইকুয়েডরের কাছে আশ্রয় পাওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট মোরেনোর বেশ কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ফাঁস করে দেন৷ এর সাথে, গোপন অ্যাকাউন্টে থাকা বিশাল অঙ্কের অর্থের হদিশও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন আসাঞ্জ৷
যুক্তরাষ্ট্রের গলার কাঁটা অ্যাসেঞ্জ
অ্যাসেঞ্জের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের। ক্লাসিফাইড ইনফরমেশন ফাঁস করার জন্য ২০১০ সালে তাকে অভিযুক্ত করা হয়, যখন উইকিলিকস নির্যাতনের বিভিন্ন বিশদ তথ্য প্রকাশ করেছিল, যার মধ্য আফগানিস্তান এবং ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর দ্বারা চালানো সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধও ছিল। যদি তাকে যুক্তরাষ্ট্রে হস্তান্তর করা হয়, তাহলে ১৭৫ বছরের সাজা হতে পারে তার। কিন্তু একজন ব্রিটিশ বিচারক তাকে হস্তান্তরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধকে আটকে দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেন অ্যাসেঞ্জের রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিল করলে পৃথক একটি মামলার জামিন লঙ্ঘনের অভিযোগে ইকুয়েডর দূতাবাস থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাত বছর ধরে একুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে থাকা অ্যাসেঞ্জকে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক এই অ্যাসেঞ্জ পেন্টাগন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লাখ লাখ সামরিক ও কূটনৈতিক গোপন নথি ফাঁস করে দিয়ে বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন।
২০১০ সালে উইকিলিকস আলোচনায় আসে৷ তারা তখন ২০০৭ সালের একটি গোপন ভিডিও প্রচার করে, যেখানে বাগদাদে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে মার্কিন মিলিটারি ডজনখানেক মানুষকে মেরে ফেলে, যার মধ্যে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সংবাদকর্মী ছিলেন৷
এরপর উইকিলিকস মার্কিন কূটনীতির লাখ লাখ গোপন নথি প্রকাশকরতে শুরু করে৷ সেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন থেকে শুরু করে সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের বিষয়ে নানান সমালোচনামূলক বার্তা, আফগান যুদ্ধের মার্কিন অপারেশনের নানা তথ্য ছিল৷
পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গুপ্তচরবৃত্তিসহ ১৮টি অভিযোগ আনা হয়৷ যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বিচার করতে চায় সুইডেন৷ ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনে ইকুয়েডরের এম্বেসিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান৷ ২০১৯ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়৷
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২২
আপনার মতামত জানানঃ