খুন ধর্ষণ শিশু নির্যাতন থেকে শুরু করে চুরি ছিনতাই দস্যুতা। স্বাভাবিক সময়ে যা ঘটত করোনাকালীন অস্থিতিশীলতায় তা যেন আরো লাগামহীন হয়ে উঠছে। অস্বাভাবিকতায় মানুষ হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। লোভে কেউ কেউ করছেন খুন, ধর্ষণ কিংবা চুরি ছিনতাই। বিপরীতে স্বর্বস্ব হারিয়ে প্রতারিত আর ভাগ্য বিড়ম্বিত হচ্ছে কেউ কেউ।
মহামারি করোনার বিচ্ছিন্ন বন্দীদশায় যখন দেশ তখন ধকল সামলাতে মাঠে তৎপর রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও। এই সময়ে সমাজ বিচ্ছিন্ন বন্দী মানুষের কারো কারো হিংস্রতা ছাড়িয়েছে সব মাত্রা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটেছে একের পর এক খুন, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা।
২০২০ সালের সারা দেশের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে, দেশে করোনা মহামারির সময় চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন—এই পাঁচ ধরনের অপরাধ বেড়েছে।
এ ছাড়া আগের বছরের (২০১৯) তুলনায় না বাড়লেও এই সময়ে দেশে খুন ও মাদকসংক্রান্ত অপরাধের ঘটনাও ঘটেছে উল্লেখসংখ্যক হারে।
চুরি ছিনতাই দস্যুতা বেড়েছে
গত বছর দেশে চুরির ঘটনা ঘটেছে ৯ হাজার ৭৩৩টি। এর মধ্যে আড়াই হাজার সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০১৯ সালে মোট চুরির ঘটনা ছিল ৯ হাজার ৩১৯টি।
২০২০ সালে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ৯৭৮টি। আর ছিনতাই (দ্রুত বিচার আইনে মামলা) ৮৭১টি। এর মধ্যে আগের বছরের তুলনায় ছিনতাই বেড়েছে ৩৪০টি। আর দস্যুতা বেড়েছে ৮২টি।
অবশ্য চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার সব ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। মামলার বাইরে থাকা ঘটনা এই হিসাবে যুক্ত হলে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এর মধ্যে দস্যুতা প্রকারান্তরে ডাকাতি।
ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন
মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার হার অন্য সাধারণ সময়ের তুলনায় বেশি। বেসরকারি সংস্থা ও পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনটি জানা যায়।
দেখা যায়, মহামারী শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে বিভিন্ন বয়সী নারী ও কন্যাশিশুর ওপর ধর্ষণের মতো নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে। উদ্বেগজনক যে, এ সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটেছে। ধর্ষণের সঙ্গে ছিল গণধর্ষণের ঘটনাও। আবার ভুক্তভোগীকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যাও করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যাও করেন।
সারা দেশের থানাগুলোতে দায়ের হওয়া মামলার ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তর অপরাধের যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায়, গত বছর সারা দেশে ৬ হাজার ৫৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দেশে দৈনিক গড়ে ১৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
এর আগের বছর, ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৫ হাজার ৮৭২টি। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, কয়েক বছর ধরেই ধর্ষণের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যার প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল।
পাশাপাশি শিশু নির্যাতনের ঘটনাও পাঁচ বছর ধরে বেড়ে চলছে। গত বছর শিশু নির্যাতনের ঘটনা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৬৩।
সারা দেশের থানাগুলোতে দায়ের হওয়া মামলার ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তর অপরাধের যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায়, গত বছর সারা দেশে ৬ হাজার ৫৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দেশে দৈনিক গড়ে ১৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ৫৩২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ১৩৯ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৪ জনকে।
যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি পর্নোগ্রাফিকেও একটা বড় কারণ মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকেরা।
খুন, অ্যাসিডসন্ত্রাস ও মাদক চোরাচালান
আগের তুলনায় না বাড়লেও ২০২০ সালে দেশে সাড়ে তিন হাজারের বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৫৩। তবে করোনাকালে বেশ কয়েকটি নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে পরিবারের সদস্য বা স্বজনেরাই জড়িত। স্ত্রী, সন্তান বা মা-বাবাসহ পরিবারের ছোট্ট শিশুকে পর্যন্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। করোনাকালে নানামুখী দুশ্চিন্তা, হতাশা ও অস্থিরতাকে এ জন্য দায়ী মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকেরা।
সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে দেশে অ্যাসিড–সন্ত্রাস অনেকাংশে কমে এলেও গত বছর ১৬টি অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। আগের বছর এমন ঘটনা ছিল ১২টি।
করোনাকালে বা বিভিন্ন সময়ে সরকার লকডাউন বা বিধিনিষেধ দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিলেও মাদক চোরাচালান ও বিক্রি বন্ধ হয়নি। পুলিশের হিসাবে গত বছর ৭৩ হাজারের বেশি মাদকদ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ১ লাখ ১১ হাজারের মতো।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য
মহামারীর সময়ে বেপরোয়া এই ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গিয়ে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা জানান, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ই এ জন্য দায়ী।
তাদের মতে, দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়া অবস্থান নিয়েছে। সারা দেশে হঠাৎ করে ধর্ষকদের এই বেপরোয়া আচরণের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, মাদকাসক্ত, দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, হতাশাগ্রস্ত ও ক্ষমতার কারণে অহংকারী ব্যক্তিরা ধর্ষণের মতো অপকর্ম ঘটাচ্ছে। আবার সমাজে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতাও ধর্ষণের ঘটনা উসকে দিচ্ছে। মূলত মহামারীতে জবাবদিহি কম থাকার কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
করোনা মহামারীতে চলাচলের শিথিলতার কারণে অনেক ধর্ষণ মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। মহামারীতে জবাবদিহি কম থাকায় ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তারা বলেন, করোনা মহামারীতে চলাচলের শিথিলতার কারণে অনেক ধর্ষণ মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। মহামারীতে জবাবদিহি কম থাকায় ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হওয়ার অনেক কারণ আছে৷ কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তাহীনতা৷ কাজের নিরাপত্তা, খাদ্যের নিরাপত্তা, সুস্থ সমাজের নিরাপত্তা— এই বিষয়গুলি যে কোনো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে৷ করোনার সময় গোটা বিশ্ব জুড়ে দুইটি বিষয় নিয়ে মানুষ অত্যধিক রকমের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ এক বেঁচে থাকার অধিকার এবং দুই কাজের অধিকার৷
তাদের বক্তব্য, গত একশ বছরে মানুষ বিশ্ব জোড়া মহামারি বা প্যানডেমিক দেখেনি৷ রোগ হলে তার প্রতিকার আছে, এই ধারণা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে৷ রোগ আছে, কিন্তু ওষুধ নেই এই ভাবনাটিই এক চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে৷ তার উপর লকডাউনের কারণে মানুষ কাজ হারাতে শুরু করেছেন৷ প্রথম বিশ্বে তাও কাজের নিরাপত্তা আছে৷ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে সেটুকুও নেই৷ ফলে মানুষ দিশাহীন হয়ে পড়েছে৷ কাজ হারানো মানুষ বুঝতে পারছেন না কীভাবে সংসার চলবে৷ যাদের কাজ আছে, তারা বুঝতে পারছেন না আগামীকাল তা থাকবে কিনা৷ এই পুরো বিষয়টি মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলছে৷ মানুষ মানসিকভাবে হিংস্র হয়ে উঠছে৷ একই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা।
তারা বলেন, অপরাধ আগে ছিল না এমন নয়৷ কিন্তু অপরাধের চরিত্র বদলেছে করোনাকালে৷ বেড়েছে সংখ্যায়৷ যত দিন যাবে, নিরাপত্তাহীনতা যত বাড়বে সংখ্যাও বাড়তে থাকবে৷ এটাই মনুষ্য সমাজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি নজর দিতে হবে কর্মসংস্থানের দিকেও। একইসাথে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে নিতে হবে নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১১
আপনার মতামত জানানঃ