আমাদের হাতে নাকি আর মাত্র ৬০০ বছর সময় আছে! নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে হলে তার আগেই নাকি পাড়ি দিতে হবে অন্য কোনো সৌরজগতে, অন্য কোনো গ্রহের সন্ধানে! না হলে মানব জাতির ধ্বংস অনিবার্য। প্রয়াত বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিভেন হকিং-এর এই বক্তব্য যেন অল্প অল্প করে সত্য হয়ে উঠছে প্রতিদিন। সেই ১৯৭০ সালের ২২শে এপ্রিল আমেরিকায় প্রায় ২ কোটি মানুষ পথে নেমেছিলেন পৃথিবী ধ্বংসে মেতে ওঠাদের বিরুদ্ধে। এরপর পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীতে তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব, তার প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে নানা আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা কয়েক দশক পার করে দিয়েছি; লাভ বলতে ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর আরও বেশি পুঁজিবাদী হয়ে ওঠা। তবে ধীরে সুস্থে ধ্বংসের লক্ষণ দেখাতে শুরু করেছে প্রকৃতি। করোনা মহামারিতে প্রায় ৪২ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি চলতি বছরেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলো মাথা নোয়াতে শুরু করেছে।
ইউরোপে বন্যা
গ্রীষ্মকালে অতিবৃষ্টির কারণে ইউরোপের জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়ামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে৷ আকস্মিক এ বন্যায় শুধুমাত্র জার্মানি ও বেলজিয়ামেই দুইশ নয় জন প্রাণ হারান৷ আর ঘরছাড়া হয়েছেন শত শত মানুষ৷ এমন বন্যা গত এক দশকেও দেখেনি ইউরোপ৷
বন্যার এক সপ্তাহ পরেও জার্মানি, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের ক্ষত শুকায়নি। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২০৫ জনের। এর মধ্যে জার্মানিতে মারা গেছে ১৭৩ জন, বেলজিয়ামে মারা গেছে ৩২ জন। গত বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) জার্মান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখনও ১৫৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল। এ অঞ্চলে বন্যার কারণে জরুরি সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। সেখানে উদ্ধারকাজ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বন্যার পানির তোড়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘরবাড়ি ধসে গেছে, গাছ উপড়ে পড়েছে, গাড়ি ভেসে গেছে।
এশিয়ায় বন্যা
অতিবৃষ্টির কারণে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুই রাষ্ট্র চীনে ও ভারতেও বন্যা দেখা দিয়েছে৷ হতাহতের সংখ্যা সেখানেও কম নয়৷ বিজ্ঞানীদের ধারণা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের কারণেই এমন পরিস্থিত তৈরি হচ্ছে যা আসছে বছরগুলোতেও হতে পারে৷
চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হেনান প্রদেশে প্রবল বন্যায় এ পর্যন্ত ৫১ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। ভারী বর্ষণে সেখানে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় কয়েক মিলিয়ন বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশটির কর্তৃপক্ষ গত শুক্রবার এ কথা জানায়।
ক্ষতিগ্রস্ত ঝিংঝু শহরের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ৩ লাখ ৯৫ হাজার লোককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বন্যার ফলে ৬৫ বিলিয়ন ইয়েনের (১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বেশি ক্ষতি হয়েছে।
বহু যুগের মধ্যে এক দিনে এত বৃষ্টি দেখেনি মধ্য চীনের হেনান প্রদেশ। আবহাওয়া দপ্তরের মতে, গত মঙ্গলবার যে বেগে বৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বাভাবিক। এক ঘণ্টায় ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে প্রদেশের কোনো কোনো শহরে।
যার জেরে জলমগ্ন হয়ে যায় প্রায় পুরো প্রদেশটিই। তার ওপর দুটি বাঁধ ভাঙার খবর মিলেছে। তার মধ্যে একটি ইয়েলো নদীর ওপর। হোয়াংহো নদীর ওপরের বাঁধও ভেঙেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে বন্যার পানি আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্র এবং গোয়ায় অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যা এবং ভূমিধসে এ পর্যন্ত ১৩৬ প্রাণহানির খবর উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষের বরাতে জানিয়েছে বিবিসি। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
৪০ বছরের মধ্যে চলতি বছরের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত দেখছে মহারাষ্ট্র। টানা বর্ষণে বিপাকে পড়েছে সেখানকার লাখো মানুষ। বেশ কয়েকটি নদীর পানি বেড়ে তীর সংলগ্ন এলাকাগুলো প্লাবিত করেছে।
পাশাপাশি ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের ১১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা তালিয়ে ও ভূমিধ্বসে অন্তত ৩৮ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন সেখানকার রাজ্য সরকার।
তাপদাহে পুড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা
ইউরোপ কিংবা এশিয়া যখন বন্যায় নাকাল, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কিছু অঞ্চল তখন উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়েছে৷ দক্ষিণ কানাডার লিটোন অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৪৯ দশমিক ছয় ডিগ্রি পর্যন্ত রেকর্ড হয়েছে৷
জুন মাসের শেষে শুরু হয়ে জুলাই মাসের শুরুর কয়েকদিন তীব্র তাপদাহ চলে কানাডায়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলা ওই তীব্র তাপপ্রবাহে দেশটির ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে প্রায় ৭১৯ জনের মৃত্যু হয়।
কানাডার ৮৪ বছর পুরনো সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে যায়। শুধু কানাডা নয়, তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মধ্যাঞ্চলের শহর লাইটনে ওই সপ্তাহে তিনবার রেকর্ড তাপমাত্রা শনাক্ত হয়। এর মধ্যে সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কম সময়ের ব্যবধানে হচ্ছে দাবানল
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের পরিবেশগত ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক টমাস স্মিথ সিএনএনকে বলেন, একটা সময় হয়ত আপনি প্রতি একশ বা দেড়শ বছরে একটা বড় দাবানল দেখতেন। তার মানে হল, পুড়ে যাওয়ার পর বনাঞ্চল আবার পুরোপুরি বেড়ে ওঠার সুযোগ পেত। কিন্তু এখন সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশে প্রতি ১০ থেকে ৩০ বছরে একবার দাবানল দেখা দিচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে বনাঞ্চলগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারছে না। ফলে বনাঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র বদলে যাচ্ছে। অরণ্য হয়ত গুল্মের জঙ্গল বা সোয়াম্পল্যান্ডের চেহারা পাচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে শীতল শহর হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় ইয়াকুটস্ক। অথচ সেই শহরটিই এখন ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা পড়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে তাপপ্রবাহ চলার ফলে কাছের বনাঞ্চল দাবানলে পুড়ছে। আগুন এতোটাই বড়, আর বাতাসের বেগ এত বেশি যে, এর ধোঁয়া সুদূর আলাস্কা পর্যন্ত চলে যাচ্ছে।
রাশিয়ার এরিয়াল ফরেস্ট প্রটেকশন সার্ভিসের তথ্য বলছে, এ বছরের শুরু থেকে ইয়াকুটিয়ায় ৬৫ লাখ একর বনভূমি পুড়িয়েছে দাবানল, যা প্রায় ৫০ লাখ ফুটবল মাঠের সমান এলাকা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন রাজ্যের বুটলেগ দাবানল বিকট আকার নিয়েছে, তার ঘন ধোঁয়া মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত তিন হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনে অগ্নিকাণ্ডের আটটি ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ ৭৫ হাজার একর এলাকা পুড়েছে বলে জানিয়েছেন একজন স্থানীয় কর্মকর্তা।
কিছুদিন আগে তীব্র তাপদাহে চরমে পৌঁছায় শীত প্রধান দেশ সাইপ্রাসে। এরপর তাপদাহে বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ দাবানলের সৃষ্টি হয়।
কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণপশ্চিম কানাডা এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অঞ্চল এখন আগের তুলনায় বেশি শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। তাতে এসব এলাকার বনাঞ্চলগুলো হয়ে উঠছে শুকনো খড়ের গাদার মতই দাহ্য।
ধ্বংসের মুখে আমাজন
বনাঞ্চল ধ্বংস ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিলুপ্তির মুখে ১০ হাজারের বেশি প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। এরই মধ্যে আমাজনের ৩৫ শতাংশ বন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে বা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এর ফলে অস্তিত্ব বিলোপের পথে আছে আট হাজারের বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ ও দুই হাজার ৩০০ প্রজাতির প্রাণী
যার ফলে বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, বিশ্বের বৃহত্তম রেইনফরেস্ট আমাজনে ব্যাপক বন ধ্বংসের ফলে অঞ্চলটির বড় অংশ যত কার্বন শোষণ করছে, তার চেয়ে বেশি নিঃসরণ করছে।
ব্রাজিল, কলম্বিয়া, পেরুসহ দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে অবস্থান আমাজন বনাঞ্চলের। ব্রাজিলে কট্টর ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারো ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বন ধ্বংস হয়েছে আমাজনে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চলে খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও কৃষিকাজের অনুমতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট, যার তীব্র বিরোধিতা করেছেন পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা।
সূত্র মতে, ২০২০ সালে এক বছর আগের তুলনায় দেশটিতে বন ধ্বংসের হার বেড়েছে আট শতাংশের বেশি। কলম্বিয়ার আমাজন অংশে বন ধ্বংসের হার বেড়ে প্রায় ৬৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিশ্বজুড়ে মঙ্গায় আক্রান্ত কয়েক কোটি মানুষ
তীব্র খরায় কারণে ফসল উৎপাদন না হওয়ায় আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারের প্রায় ১১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ তীব্র খাবার সংকটে পড়েছে৷ পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সেখানকার মানুষ ক্ষুধা মেটাতে ক্যাকটাস ও পোকামাকড় খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় আছে৷
সারা বিশ্বে ধনী-গরিবের পার্থক্য বেড়েই চলেছে৷ দেশভেদে, অঞ্চলভেদে পার্থক্যটা অনেক বেড়ে যায়৷ খাওয়া-দাওয়াতেও একই বৈষম্য৷ কোটি কোটি মানুষ নিয়মিত খাবার পায় না, অনেকে আবার প্রচুর খাবার অপচয় করে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে অন্তত ৮২ কোটি মানুষ রাতে না খেয়েই ঘুমাতে যায়৷ যেখানে ৮২ কোটি মানুষ একবেলা কোনো খাবার পায় না, সেখানে সারা বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ২২ কোটি ২০ লাখ টন খাবার নষ্ট বা অপচয় করা হয়৷ জানা যায়, ইউরোপ এবং পূর্ব অ্যামেরিকার মানুষ গড়ে প্রতি বছর ৯৫ থেকে ১১৫ কিলোগ্রাম খাবার না খেয়ে ফেলে দেয়৷
উন্নত দেশগুলোতে বছরে মাথা পিছু খাবারের পরিমাণ ৯০০ কেজি, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে এর পরিমাণ মাত্র ৪৬০ কেজি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৫৩
আপনার মতামত জানানঃ