আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অক্সিজেনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাবার। সেই প্রাচীনকাল থেকেই একমুঠো খাবারের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ করে অসংখ্য মানুষ। তবে অর্থনীতি আর সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে খাবারের ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। আগে দরকারের বাইরে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত খাবার কথা চিন্তাই করত না, অথচ আজকাল প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষই রেস্টুরেন্টে খাবার খায়। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি রেস্টুরেন্টের বদৌলতে নানা দেশের নানা স্বাদের খাবারও আজকাল খাবার সুযোগ মিলছে। কিন্তু এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে খাবার নষ্ট আর অপচয় হওয়া। অথচ বিশ্বে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাবারের চাহিদা, অসংখ্য মানুষ অভুক্ত থাকার পরও প্রচুর খাবার নষ্ট হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর আড়াই কোটি মেট্রিক টন খাবার নষ্ট হয় বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এবং ইউকে গ্রোসারি রিটেইলার টেসকোর (টিএসসিডিএফ) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন। আড়াই কোটি মেট্রিক টন নষ্ট খাবারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক পরিমাণই নষ্ট হয় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক ফার্মগুলোতে। এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে জলবায়ুর ওপরও। খবর সিএনএন
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বে যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয় তার পরিমাণ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পূর্বের অনুমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি। এফএও সর্বশেষ ২০১১ সালে এই হিসাব করেছিল।
বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ফার্মগুলোতে নষ্ট হওয়া খাদ্যের পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি মেট্রিক টন। আরও ৯৩ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন খাবার নষ্ট করে রিটেইলার ও ভোক্তারা। বাকি অংশ নষ্ট হয় খাবারের পরিবহন, সংরক্ষণ, উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়।
নতুন এই হিসাব অনুযায়ী জানা যায়, বিশ্বের মোট উৎপাদিত খাদ্যের ৪০ শতাংশই খাওয়া হয় না।
গবেষণাটির ফলাফল অনুযায়ী, ১০ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী খাদ্য আবর্জনা। এ সংখ্যা আগে ৮ শতাংশ বলে ধারণা করা হতো। এ সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গাড়ি চালানোর ফলে সৃষ্ট গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের দাবানল ও ভয়াবহ বন্যা আমাদের প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী ভয়াবহ হতে পারে।
“খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিশাল পরিমাণ জমি লাগে, পানি ও শক্তির খরচও আছে। অর্থাৎ খাদ্যের অপচয় জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর ভূমিকা রাখছে,” বলা হয় গবেষণা প্রতিবেদনটিতে।
বিশ্বের মোট উৎপাদিত খাদ্যের ৪০ শতাংশই খাওয়া হয় না।
গবেষণা প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বিশ্বজুড়ে মোট অপচয় হওয়া ফসলের ৫৮ শতাংশের জন্য দায়ী ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার ধনী দেশগুলো, যদিও এসব দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ মাত্র। তারপরও দেশগুলোতে খাদ্য অপচয় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ বিক্রি ও ভোক্তা পর্যায়েই সীমাবদ্ধ।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “খামার পর্যায়ে খাদ্য অপচয় গুরুতর হলেও এড়িয়ে যাওয়া হয়, খাবার নষ্টের হটস্পট এই ক্ষেত্র,”।
বাজার ও কৃষকদের মধ্যে যোগাযোগের অভাবের কারণে ফসল উৎপাদনের পরিমাণের অসামঞ্জস্যতা, কী ধরনের ফসল রোপণ করা হবে এবং ফসল রোপণের সময়— এসব কারণেই মূলত প্রতি বছর বিশাল পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়।
খাদ্য সংকটে দুর্ভিক্ষের মুখে বিশ্ব
করোনা মহামারি চলাকালে বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়ছে খাবারের দাম। মৌলিক খাদ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীব্যাপী খাদ্য সুরক্ষার ওপর চাপ বেড়েছে। এতে বিশ্বের প্রায় চার কোটি ১০ লাখের মতো মানুষ আসন্ন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
রয়টার্স জাতিসংঘের বরাত দিয়ে বলছে, বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে প্রতি বেলা খাবার পায় না এমন মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পর দেশে দেশে সংঘাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০১৬ সাল থেকে সেই সংখ্যাটা আবার বাড়তে শুরু করে।
ডব্লিউএফপির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দুর্ভিক্ষের মুখে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৭০ লাখ। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এই সংখ্যাটা দ্রুত বাড়তে থাকে। আর চলতি বছর তা চার কোটি ছাড়িয়েছে।
ক্ষুধা নিরসনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে শান্তিতে নোবেল পাওয়া ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৬৯ কোটি মানুষ এখনো প্রতিদিন রাতে কোনো খাবার না খেয়ে ঘুমাতে যান।
খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে জোগান কমে যাওয়া কথা বলা হয়েছে। মহামারির মধ্যে পরিবহন ও শ্রমিক সংকটে খাদ্য পণ্যের উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটেছে। আর উৎপাদন কমে যাওয়ায় জোগানেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি দেশে খাদ্যপণ্যের চাহিদাও বেড়ে গেছে।
যার ফলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মুদ্রাস্ফীতি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যপণ্যের পেছনে মানুষের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মহামারি পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারেও তার উচ্চ প্রভাব পড়বে বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাবারের অপচয় বন্ধ করা জরুরি কেন
শুধুমাত্র গরীবেরা খাবার পাচ্ছে না তাই খাবার অপচয় বন্ধ করা বা কমানো দরকার এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খাবার অপচয় শুধু খাবারের অপচয় না, একই সাথে অর্থ, শ্রম, শক্তির অপচয়। ফসল ফলানো থেকে খাবার কেনা পর্যন্ত প্রচুর মানুষ জড়িত। এতে তারা তাদের অর্থ দেন, শ্রম দেন। কিন্তু তাদের দেয়া অর্থ আর শ্রমের খাবার যদি নষ্ট হয় তাহলে সেই অর্থ আর শ্রমও নষ্টই হয় শেষ পর্যন্ত।
ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ পরিবহন, ট্রাক্টর কিংবা ফসল পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে খাবার প্রক্রিয়াজাত কারখানা থেকে নিঃসরিত হচ্ছে বিভিন্ন গ্রীনহাউস গ্যাস। রান্না করা খাবার তৈরিতেও কিন্তু জ্বালানী ও পানির প্রয়োজন হয়। খাবার যদি নষ্টই হয় শেষ পর্যন্ত তাহলে একই সাথে প্রচুর জ্বালানী নষ্ট হচ্ছে আর সাথে বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাস। আবার অন্যদিকে খাবার সাথে পানিরও অপচয় হচ্ছে। ফলে একদিকে খাবার যেমন নষ্ট হলো, পরিবেশেরও ক্ষতি হলো। খাবার নষ্ট না হলে অন্তত একদিক থেকে তো লাভ ছিল! সবদিক বিবেচনা করলে খাবার নষ্ট বা অপচয় হলে শুধু খাবারই নষ্ট হয় এমন না, বরং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিও যুক্ত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগেই যুদ্ধ এবং নানা আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে খাদ্য সংকট বেড়ে গিয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন একে আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অতিমারীর পর খাদ্য সংকট এখন একটি বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের পিট পিয়ারসন এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা সবাই বহু বছর ধরে জানি যে খাবার নষ্ট হওয়ার সমস্যাটি কমিয়ে আনা সম্ভব। ফলে প্রকৃতি ও জলবায়ুর ওপরও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কমানো সম্ভব হবে। নতুন প্রকাশিত এই প্রতিবেদন দেখিয়েছে আমাদের ধারণার চেয়েও বড় এ সমস্যা,”
পরিবেশের ওপর এতো বিরাট মাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়া সত্ত্বেও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে মাত্র ১১টি জাতীয় কার্বন প্ল্যানে খাদ্য অপচয় ও নষ্টের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
এরমধ্যে বেশিরভাগই আবার আফ্রিকার দেশগুলো, যারা বর্তমানে ফসল তোলার পরবর্তী সময়ের ক্ষতির মুখে আছে। যদিও শিল্পোন্নত দেশগুলোর কৃষি ব্যবস্থা ও খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া এ সমস্যার জন্য বহুলাংশে দায়ী।
দেশগুলোর সরকার ও খাদ্য শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের খাদ্য অপচয় কমিয়ে আনতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার, সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম ও সাপ্লাই চেইনে নষ্ট হওয়া খাবারের পরিমাণ কমাতে পরিকল্পনা নির্ধারণের আহ্বান জানানো হয় প্রতিবেদনটিতে।
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, ২০৭৫ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯৫০ কোটি।
এই বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য ভবিষ্যতে আরও খাদ্যের দরকার হবে। এ অবস্থায় খাদ্যের এই বিপুল অপচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন গবেষকরা ।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, যেখানে বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যান, সেখানে এই অপচয় মেনে নেয়া যায় না। শুধুমাত্র অপচয় বন্ধ করেই এই সমস্যার সমাধান করা যেত বলে তারা মনে করেন।
বলেন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, মানুষের অভ্যাস ও বিভিন্ন কারণে মানুষের খাদ্যের অপচয় হয়। আর খাদ্যের অপচয় হলে তার উৎপাদনে ব্যবহৃত পানি, জমির শক্তি ও অর্থের অপচয় ঘটে। কৃষকসহ বেসরকারি পর্যায়ে সচেতন হলে প্রচুর পরিমাণ খাদ্য অপচয় রোধ করা সম্ভব।
তারা বলেন, আমরা সবাই সমাধানের অংশ হয়ে এই সমস্যাকে মোকাবেলা করতে পারি। আমরা আমাদের পরিবারে, পর্যটন খাত, রেস্তোরাঁ, ক্যান্টিন, সুপার মার্কেটসহ সব জায়গায়ই যেখানে খাদ্য তৈরি, বিক্রি অথবা খাওয়া হয় সব জায়গাতেই ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের সমাজে যাদের প্রাচুর্য রয়েছে তাদের কাছ থেকেও এটা শুরু হতে পারে, কেননা তারা অনেকেই সবজিটা দেখতে সুন্দর নয় বলে তা ফেলে দেন।
বলেন, বিক্রির জন্য তারিখ বেঁধে দেয়ার যে ব্যবস্থা চালু আছে সেটাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। বিক্রির এই তারিখ শুধু নির্দেশনামূলক, ওই তারিখের পর তা ফেলে দিতে হবে বিষয়টা এমন নয়।
ব্যক্তি, পরিবার থেকে শুরু করে পুরো দেশের উন্নতির পেছনে শিক্ষার কতটা ভূমিকা, সময় আমাদের তা দেখিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য সংকট ধ্বংসাত্মক ফলাফল আনতে পারে: নিদারুণ এবং অনিবার্য মৃত্যু, সহিংসতা ও গণস্থানান্তর।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট এড়িয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। বিশ্বের অত্যন্ত দুর্বল একটি দেশে যা ঘটে তার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশটির ওপরও পড়ে।
তারা বলেন, বিশ্বের নেতাদের খুব সহজ কিছু কাজ করতে হবে, এখনই খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কাজ করা, অন্যথায় পরবর্তী সময়ে চরম মূল্য দেয়া। একাধিক দুর্ভিক্ষের যাতনা ভোগের পাশাপাশি একটি শিক্ষাবঞ্চিত প্রজন্ম তৈরি করার চেয়ে তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপে পরিস্থিতি মোকাবেলা সহজ এবং অনেক প্রাণও রক্ষা পাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৯
আপনার মতামত জানানঃ