করোনার সময় সবচেয়ে বেশি কমেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের আয়। এসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের আয় কমেছে ৬৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের এক জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্যালাপের জরিপে দেখা গেছে, করোনার সময় সবচেয়ে বেশি কমেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের আয়, ৬৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। এই হার সবচেয়ে কম পশ্চিম ইউরোপ। এখানকার ২৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের আয় কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার ৬৬ শতাংশ বলেছেন, তারা সাময়িকভাবে কাজ থেকে ছিটকে পড়েছেন। ৫০ শতাংশ মানুষ বলছেন, করোনার কারণে তারা চাকরি হারিয়েছেন। সবচেয়ে কম চাকরি হারিয়েছেন ইউরোপের মানুষ, ৬ শতাংশ।
বিশ্বের ১১৬টি দেশের মানুষের ওপর ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১ ’-শীর্ষক এই সমীক্ষা চালিয়েছে গ্যালাপ।
এতে বলা হয়, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতি দুজন মানুষের একজনের আয় কমেছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, কারো কর্মঘণ্টা কমেছে।
বিশ্বের ১১৭ দেশের তিন লাখ মানুষের ওপর করা এই জরিপে দেখা যায়, অর্ধেক মানুষেরই আয় কমেছে করোনা মহামারির সংকটের কারণে। বৈশ্বিক হিসাবে, আনুমানিক ১৬০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের আয় কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আয় কমার এই প্রবণতা থাইল্যান্ডে সর্বোচ্চ ৭৬ শতাংশ এবং সুইজারল্যান্ডে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ মানুষের দেখা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বলিভিয়া, মিয়ানমার, কেনিয়া, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া, হন্ডুরাস, ইকুয়েডরসহ ৫৪ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে, তারা করোনা সংকটের আগে যা আয় করত সংকট শুরু হওয়ার পর তার চেয়ে আয় কমেছে। বাংলাদেশের ৬৩ শতাংশ মানুষ তাদের আয় কমার কথা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এমনটি জানিয়েছে ৩৪ শতাংশ মানুষ।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় সর্বোচ্চ ৫৪ শতাংশ মানুষের জীবনে করোনার প্রভাব পড়েছে। এরপরই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। তাদের ৫০ শতাংশ মানুষের ওপর করোনার প্রভাব পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ৪৯ শতাংশ মানুষের ওপর প্রভাব পড়েছে করোনার। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সর্বনিম্ন ২২ শতাংশ মানুষের ওপর প্রভাব পড়েছে।
জরিপে প্রতি তিনজনে একজন জানিয়েছেন, করোনার কারণে তিনি তার চাকরি বা ব্যবসা হারিয়েছেন। বৈশ্বিক হিসাবে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০ কোটির বেশি মানুষ। অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানিতে প্রতি ১০ জনে একজন বলেছেন, তারা সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ রেখেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ৩৯ শতাংশ। ফিলিপাইন, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ের ৬০ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরি হারানো বা ব্যবসা লাটে ওঠার কথা জানিয়েছে। সুইজারল্যান্ডে এই হার ৩ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ শতাংশ।
জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী কর্মীদের মধ্যে প্রতিদিনই উদ্বিগ্নতা, চাপ, ক্রোধ ও দুঃখবোধ বাড়ছে। ৪১ শতাংশ কর্মী জানান, আগের দিনে তারা অনেক উদ্বিগ্ন ছিলেন। ৪৩ শতাংশ জানান, আগের দিন ব্যাপক চাপে ছিলেন তারা। ২৪ শতাংশ জানান, তারা ক্রোধ অনুভব করেছেন। ২৫ শতাংশ অনুভব করেছেন দুঃখ।
গ্যালাপের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের কর্মীদের উদ্বেগ, মানসিক চাপ, ক্রোধ ও দুঃখবোধ আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে বেড়েছে। বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ কর্মী জানান, আগের দিনে তারা অনেক উদ্বিগ্ন ছিলেন। ৪১ শতাংশ জানান, আগের দিন ব্যাপক চাপে ছিলেন তারা। ২৫ শতাংশ জানান, তারা ক্রোধ অনুভব করেছেন। ৩৬ শতাংশ অনুভব করেছেন দুঃখ।
জরিপে প্রতি তিনজনে একজন জানিয়েছেন, করোনার কারণে তিনি তার চাকরি বা ব্যবসা হারিয়েছেন। বৈশ্বিক হিসাবে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০ কোটির বেশি মানুষ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ বলছে, করোনার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মৃত্যু, লকডাউন, স্কুল বন্ধ থাকায় ওপরের ফলাফল অবাক হওয়ার মতো নয়। করোনার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে, টিকে থাকতে কোটি কোটি শ্রমিককে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
২০০৫ সাল থেকে এই জরিপ করে আসছে গ্যালাপ। তবে এবারে জরিপের পদ্ধতি অনেকটাই পাল্টেছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে, আগের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি ব্যবহার করে জরিপ পরিচালনা করা নিরাপদ ও সম্ভব ছিল না। তাই মুখোমুখি প্রশ্ন না করে ফোনে বা অন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই জরিপ চালানো হয়। ১৫ ওপরের বয়সী মানুষের ওপর এই জরিপ চালানো হয়।
বিপর্যয়ের মুখে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি
আমেরিকার জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় জানা গেছে, দৈনিক সংক্রমণের হারে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে ইন্দোনেশিয়া। টিকাদানেও পিছিয়ে আছে তারা। শুধু ইন্দোনেশিয়া নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিত্রই এখন অনেকটা এ রকম। তাতে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার মুখে। এশিয়ার এ অঞ্চলের দেশগুলো যে অদূর ভবিষ্যতে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, তেমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং অর্থনীতির আরও বেহাল হওয়ারই আশঙ্কা রয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দ করতে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই এখন ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতির মুখে। যে সমস্যা খুব শিগগির মিটে যাবে, এমন সম্ভাবনা নেই। সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে আরও বেশি সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে এসব দেশ। তাদের মুদ্রার মান কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে বেহাল অবস্থা থাইল্যান্ডের মুদ্রা বাহতের, এই মুদ্রার মান জুনের মাঝামাঝি থেকে কমেছে ৫ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে পর্যটন–নির্ভর এই দেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। অন্যদিকে ফিলিপাইনের মুদ্রা পেসোর মূল্য হ্রাস পেয়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মহামারির আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সামগ্রিক অর্থনীতি ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জার্মানির পরেই। আর এখন মহামারির দাপটে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়া এ বছরে তাদের জিডিপির পূর্বাভাসের সীমা অনেকটাই কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে। একই অবস্থা থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ এই অঞ্চলের বহু দেশের। গত অর্থবছরে উঠে দাঁড়ালেও ভিয়েতনামের অবস্থাও মহামারি পরিস্থিতিতে তথৈবচ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই সমস্যা থেকে খুব শিগগির বেরিয়ে আসার আলো দেখা যাচ্ছে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূলত ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানিই ছিল এই দেশগুলোর অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু কঠোর বিধিনিষেধে সেই সব শিল্পকারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, টানা কঠোর বিধিনিষেধ চালিয়ে গেলে কাজ হবে না, বরং টিকাদানের গতি অনেক গুণ বাড়াতে হবে। তা না হলে সংক্রমণে তো রাশ টানা যাবেই না, অর্থনীতি আরও মুখ থুবড়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৯
আপনার মতামত জানানঃ