সৌদি আরবের অধিকাংশ বিদেশি পর্যটক ইসলামের দুই পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনাতেই ঘোরাফেরা সীমিত রাখেন। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে সৌদি আরবের পর্যটন মূলত হজ ও ওমরাহকেন্দ্রিক। সম্প্রতি পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। মুসলিমদের সর্ববৃহৎ এ মিলনমেলা করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পরপর দুই বছর সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হলো। এর মধ্যেই বিশাল পর্যটন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। খবর আল জাজিরা
হজ শেষে এবার অমুসলিমদের জন্য ধর্ম নিরপেক্ষ পর্যটন চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে সৌদি আরব। তেলের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমাতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিদেশি, বিশেষ করে পশ্চিমা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বড় বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন তিনি।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদিতে বিদেশি নাগরিক টানার পাশাপাশি দেশটির নাগরিকদের আগ্রহও দেশীয় পর্যটনেই ধরে রাখতে চান তারা। ২০১৯ সালে ভ্রমণে দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার খরচ করেছে সৌদি নাগরিকরা। সৌদি আরবের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বয়স ৩০ বছরের কম। এ বিশাল তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগই বিনোদনের জন্য দেশের বাইরে যেতে আগ্রহী।
অমুসলিম পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ই-ভিসা চালু করে রিয়াদ। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে সেই উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি। উল্টো ধর্মভিত্তিক পর্যটনও বড় ধাক্কা খেয়েছে।
ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে চলতি বছর নাগরিক ও অভিবাসীসহ সৌদি আরবে বসবাসরত মাত্র ৬০ হাজার মানুষকে হজের অনুমতি দেয়া হয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার।
দীর্ঘদিন সীমান্ত বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের ৩০ মে কয়েকটি দেশের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দেয় সৌদি সরকার। কিন্তু রূপ পরিবর্তিত ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস, বিশেষ করে অধিক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আবারও বিভিন্ন সীমান্ত বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে রিয়াদ।
জেদ্দাভিত্তিক পর্যটন উপদেষ্টা ক্রিস রোজেনক্র্যান্স বলেন, ‘নজিরবিহীন আরেকটি বছর পার করছি আমরা। ধর্মভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা থমকে তো গেছেই, সাংস্কৃতিক বা রোমাঞ্চকেন্দ্রিক পর্যটনেও ধস নেমেছে।’
জেদ্দার ট্যুর গাইড সামির কোমোসানি বলেন, ‘এই বিশাল ও সুন্দর দেশটি থেকে পর্যটকদের অনেক কিছু পাওয়ার আছে। আমারও পর্যটকদের এসব দেখাতে ভালো লাগে। কিন্তু করোনার কারণে সারা পৃথিবী থেকে পর্যটক আসা কমে গেছে।’
পর্যটন খাত সমৃদ্ধ করে তোলার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধি তিন শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশে নেয়ার বিষয়ে আশাবাদী রিয়াদ।
২০৩০-এর দশকের মধ্যে পর্যটকের সংখ্যা বছরে ১০ কোটিতে নিতে চায় সৌদি প্রশাসন। একই সঙ্গে ২০২৫ সালের মধ্যে ধর্মভিত্তিক পর্যটকের সংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন কোটিতে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রাও নিয়েছে রিয়াদ।
এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের স্থান সংকুলান নিশ্চিতে অবকাঠামোগত সম্প্রসারণের কাজও শুরু করেছে রিয়াদ। চলতি মাসেই একটি নতুন সরকারি বিমান সংস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি যুবরাজ। আগামী নয় বছরে পরিবহন খাতেই প্রায় ১৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চান তিনি।
রিয়াদে একটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি হচ্ছে বলেও সম্প্রতি সূত্রের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে ব্লুমবার্গ। এরকম বিভিন্ন উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে সৌদি আরবের লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটছে।
লোহিত সাগর উপকূলে পরিবেশবান্ধব প্রবালকেন্দ্রিক পর্যটন গড়ে তুলতে ৫০টি হোটেল ও এক হাজার ৩০০ আবাসিক ইউনিট নির্মাণাধীন।
সৌদি আরবে সরকারি বিনিয়োগ তহবিল (পিআইএফ) ৩৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলতেও বিনিয়োগ করছে।
সৌদি যুবরাজের অর্থনীতি পুনর্গঠন কর্মসূচির কেন্দ্রে থাকা কার্বনমুক্ত মরু মেগাসিটি তৈরিতে ৫০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে পিআইএফ।
সৌদি আরবের এসব পরিকল্পনার বিপরীতে ঝুঁকি হিসেবে রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে কয়েক দশক ধরে পরিচালিত জনপ্রিয় সব পর্যটন কেন্দ্র।
যেমন লোহিত সাগর উপকূলে তুলনামূলক সস্তা মিসরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র শার্ম আল-শেখ বিচ রিসোর্ট। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও শার্ম আল-শেখে সামাজিক আচরণবিধি ও অ্যালকোহল বিক্রির নীতিমালা অত্যন্ত শিথিল।
আবার উত্তরে রয়েছে জর্ডানের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পেত্রা ও ওয়াদি রাম।
তেলনির্ভর অর্থনীতি সংস্কারে সংযুক্ত আরব আমিরাতও পর্যটনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
প্রতিবেশীদের টেক্কা দিতে ইসলাম ধর্মে উল্লেখিত পবিত্রতম দুই নগরীকে হাতিয়ার করেছে সৌদি প্রশাসন। হজ ও উমরাহকেন্দ্রিক পর্যটনের ইতিহাস দেশটিতে হাজার বছরের।
মক্কা ও মদিনায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও ইসলামের সংস্কৃতি-ইতিহাস দেখে ফেরার পর তাদের সৌদি আরবের অন্যান্য অঞ্চল ঘুরে দেখার বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ।
এক্ষেত্রে ধর্মীয় আচারে অংশ নেয়া পর্যটকদের ধর্মে নিষিদ্ধ অ্যালকোহল বা সামাজিক আচরণবিধি শিথিলকৃত পরিবেশে কিভাবে স্বস্তি দেয়া যায়, তা নিয়েও চলছে বিস্তর গবেষণা।
অমুসলিম পর্যটকরা সৌদির বিখ্যাত কয়েকটি মসজিদ পরিদর্শনের সুযোগ পেতেন
এর আগে সৌদি আরবের চারটি বিখ্যাত মসজিদ পরিদর্শন করার সুযোগ ছিল অমুসলিম পর্যটকদের। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দেশটির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
তবে আল্লাহর ঘর মসজিদে প্রবেশ করার সময় অমুসলিমদের এগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। তাদেরকে খেয়াল রাখতে হয়, কোনোভাবেই যেন এগুলোর পবিত্রতা নষ্ট না হয়।
অমুসলিমরা সৌদি আরবের যে চারটি মসজিদে যেতে পারবে সেগুলো হলো— আর রাহমা, আত তাকওয়া, কিং ফাহাদ ও কিং সৌদ মসজিদ। এই চারটি মসজিদই জেদ্দা নগরীতে অবস্থিত। স্থাপত্য শৈল্পীর কারণে এ মসজিদগুলোর খ্যাতি রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী আর রাহমা মসজিদটি বরাবরই বিদেশি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। জেদ্দা সফরের সময় প্রায় সবাই এই মসজিদটি পরিদর্শন করে থাকেন। লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত মসজিদটি স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কি স্থাপত্য শিল্প? এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ। সাগরের তীরে অবস্থিত মসজিদটিকে দেখতে দ্বীপের মত লাগে। এ কারণে অনেকে একে ভাসমান মসজিদ হিসেবেও উল্লেখ করে থাকেন। যদিও এটি সাগরে ভাসমান নয়। তবে এর কিছু স্তম্ভ সাগরের তলদেশ থেকে নির্মিত হয়েছে।
আত তাকওয়া মসজিদটি নির্মিত হয়েছে ২০০৫ সালে। এর অবস্থান জেদ্দার উত্তরে। সাড়ে সাতশ’ বর্গমিটারের এই মসজিদটিতে একসঙ্গে ৪শ’র বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।
জেদ্দার কিং ফাহাদ মসজিদটি মরক্কো স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন। বিশেষ করে এর টালির কাজ। মুর স্থাপত্যশৈলীর আদলে এতে নির্মিত হয়েছে ত্রিকোণাকৃতির গম্বুজ ও খিলান। এ কারণেই সৌদি আরবের অন্যান্য মসজিদের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
জেদ্দার সবচেয়ে বড় মসজিদ হচ্ছে কিং সৌদ মসজিদ। মোট ৯৭০০ বর্গমিটার এলাকা নিয়ে এর অবস্থান। সুবৃহৎ এ মসজিদের গম্বুজটিও বেশ বড়। এর ব্যাস ২০ মিটার এবং উচ্চতা ৪২। মিনারের উচ্চতা ৬০ মিটার। মিসরের বিখ্যাত স্থপতি আবদেল ওয়াহেদ ওয়াকিল এর নকশা করা এ মসজিদটি নির্মিত হয় ১৯৮৭ সালে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৯
আপনার মতামত জানানঃ