জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান দু’টি পদার্থ কয়লা আর ডিজেল। এ দু’টি পদার্থের ব্যবহার এখন পৃথিবীতে সব থেকে বেশি। ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়ে গেছে মারাত্মকভাবে। কার্বনের এই নিঃসরণ যদি কমিয়ে আনা না-যায় তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে এক বার করে ৩০ কোটি মানুষ বসবাসের বিশাল এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে বলে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে।
মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের দিক থেকে দায়ীদের মধ্যে শীর্ষে মধ্যপ্রাচ্য আর শিল্পোন্নত দেশগুলো৷ তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে, তার চেয়ে একাই বেশি নিঃসরণ করছে চীন। জলবায়ু উষ্ণকারী গ্যাস নিঃসরণে দেশ ভিত্তিক প্রভাব ও পার্থক্য নিয়ে গবেষণা হলেও এবার লিঙ্গ ভিত্তিক প্রভাব ও পার্থক্য নিয়ে গবেষণা হয়েছে।
দুই লিঙ্গের মধ্যে পর্যালোচনামূলক এ গবেষনা করা হয় সুইডেনে। এতে দেখা যায়, নানান ধরনের পণ্য ক্রয়ে পুরুষরা যে অর্থ ব্যয় করেন তার কারণে নারীদের চাইতে ১৬ শতাংশ বেশি জলবায়ু উষ্ণতা সৃষ্টিকারী গ্যাস নিঃসরণ হয়। খরচের পরিমাণ প্রায় একই হওয়ার পরও পণ্য নির্বাচনের ভিন্নতাই এক্ষেত্রে মূল কারণ। সবচেয়ে বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে কারের ডিজেল ও পেট্রোলের জন্য পুরুষদের করা খরচ। খবর দ্য গার্ডিয়ান।
এতে আরও দেখা যায়, খাদ্য ও ছুটি কাটাতে করা খরচে নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গের ক্ষেত্রেই তাদের সৃষ্ট মোট নিঃসরণের অর্ধেকের বেশি ঘটছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাংসের পরিবর্তে উদ্ভিদজাত খাদ্য গ্রহণ করলে এবং ছুটি কাটাতে বিমান বা ব্যক্তিগত গাড়িতে ভ্রমণের চাইতে ট্রেনের মতো গণপরিবহন ব্যবহার করলে মানবসৃষ্ট নিঃসরণ ৪০ শতাংশ কমে আসবে।
গবেষণা সংস্থা- সুইডিশ রিসার্চ কোম্পানি ইকোলুপের বিশেষজ্ঞ আনিকা কার্লসন কানায়েমা বলেন, “নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য আমলে নিয়ে সঠিক পরিবেশ নীতি গ্রহণ করা সম্ভব বলে আমরা মনে করছি,”
“উভয় পক্ষের ব্যয় প্রবণতা ছিল প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন; নারীরা গৃহসজ্জা, স্বাস্থ্য এবং পোশাকে বেশি অর্থ ব্যয় করেন। আর পুরুষরা করছেন গাড়ির জ্বালানি, ঘরের বাইরে খাদ্য গ্রহণ, অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় এবং তামাকের পেছনে।”
বৈজ্ঞানিক সাময়িকী জার্নাল ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোলজিতে প্রকাশিত এ গবেষণায় অবশ্য কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত ভাড়া করা গাড়ি বা ট্যাক্সির জ্বালানি ব্যয়কে হিসাবে রাখা হয়নি।
তবে এর আগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়িতে গাড়ি থাকলে সেটি চালিয়ে নারীদের তুলনায় পুরুষেরাই বেশি কর্মস্থলে যান। সে তুলনায় নারীরা গণপরিবহন বেশি ব্যবহার করেন।
এককভাবে সবচেয়ে বেশি বা এক-তৃতীয়াংশ দূষণ করছে ছুটির সময়ে করা ব্যয়। এক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষ সমান অবস্থানে। “এটি প্রত্যাশিত মাত্রার চাইতেও অনেকগুণ” বলে উল্লেখ করেন কার্লসন কানায়েমা।
গবেষণায় পরিবার থাকা মানুষের খরচের তথ্য না থাকায় একাকী জীবনযাপন করাদের তথ্যই গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা ডায়েট পরিবর্তন ও ছুটি কাটানোর সময় করা নিঃসরণকে কমানর উপর গুরুত্ব দিয়েছি, কারণ এতে করে কাউকে নতুন ইলেকট্রিক গাড়ি ক্রয়ের মতো বাড়তি খরচ করতে হবে না। শুধু একটু সতর্ক থাকলেই পরিবেশে বিরূপ প্রভাব অনেক কমাতে পারবেন তারা। তাছাড়া, এই লক্ষ্যটি আমরা চাইলেই এ মুহূর্তে অর্জন করতে পারি। এজন্য একই পরিমাণ টাকা দিয়ে কম দূষণকারী পণ্য কিনলেই চলবে।”
জলবায়ু উষ্ণকারী গ্যাস নিঃসরণে লিঙ্গ ভিত্তিক প্রভাব ও পার্থক্য নিয়ে এর আগে খুব কম গবেষণাই হয়েছে। এব্যাপারে সাম্প্রতিক গবেষণার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জলবায়ু সংকট সফলভাবে মোকাবিলা করতে হলে এই পার্থক্যকে অনুধাবন করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লা আর ডিজেলের সর্বাধিক ব্যবহারের ফলে আজ ভয়াবহ এই দুর্যোগ বিশ্ববাসীর সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনও গুরুত্ব দিচ্ছি না। যেন কিছুই ঘটছে না— এরকম ভাব বজায় রেখে আমরা আছি দিব্যি। এই মানসিকতা দুঃখজনক বৈ আর কিছু নয়। অথচ বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি হিসেবে কয়লা, ডিজেলের ব্যবহার যেভাবে বেড়ে গেছে, তাতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, কয়লা ও ডিজেলের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি নিঃসরণ ঘটে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের। এই গ্যাস শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতাই বাড়াচ্ছে না, ওজোনস্তরকেও দুর্বল করে দিচ্ছে দিন দিন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় শিল্পোন্নত দেশগুলো মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহার করছে কয়লা, ডিজেল। এতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উদ্গীরণ বেড়ে গেছে ভয়াবহরকমভাবে। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন স্তরকে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করবার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়াবার পথ হলো, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ