বিশ্বের বড় বড় তেল কোম্পানিগুলো তাদের তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের তথ্য গোপন রেখেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- বিপি, এনি, এক্সনমোবিল, শেভরন এবং শেল।
বিবিসি বলছে, তেল উৎপাদনের সময় উত্তোলন করা তেল থেকে যে বাড়তি প্রাকৃতিক গ্যাস নির্গত হয় তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর এ থেকে বাতাসে নির্গত হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং কালো ধোঁয়ার মারাত্মক এক মিশ্রণ, যা বায়ুদূষণ ঘটায় এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তরান্বিত করে।
ইরাকে যেসব তেল ক্ষেত্রে পোড়ানো গ্যাস চুল্লি থেকে বেরচ্ছে, তার কাছাকাছি যেসব মানুষ বসবাস করে, সেখানকার বাতাসে বিবিসি উচ্চ মাত্রার এমন সব রাসায়নিক পেয়েছে, যার থেকে ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে।
বিবিসির অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে যে এই তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে উচ্চ মাত্রার অঘোষিত গ্যাস বায়ুমণ্ডলে পুড়ে মিশে যায়।
এ খবরের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ মানবাধিকার ও পরিবেশবিষয়ক বিশেষ দূত ডিভিড বয়েড এইসব এলাকার মানুষদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘এগুলো হলো আধুনিক যুগের বলিদান অঞ্চল, যেখানে মানুষের স্বাস্থ্য, মানবাধিকার এবং পরিবেশকে বলি দেয়া হচ্ছে মুনাফা আর ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে।’
এই প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দিন ধরেই স্বীকার করে আসছে যে জরুরি কারণ ছাড়া সব রকম বাড়তি গ্যাস পোড়ানো বন্ধ করা প্রয়োজন।
বিপি, এনি, এক্সনমোবিল, শেভরন আর শেল কোম্পানি ২০১৫ সালে দেয়া বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিশ্রুতি মেনে অঙ্গীকার করেছিল তারা কতটা অবাঞ্ছিত গ্যাস পোড়াচ্ছে তা ঘোষণা করবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে জরুরি কারণ ছাড়া এভাবে গ্যাস পোড়ানো বন্ধ করে দেবে। শেল বলেছিল তারা ২০২৫ সালের মধ্যেই এটা বন্ধ করবে।
কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যেসব ক্ষেত্রে তারা দৈনন্দিন পরিচালনার জন্য অন্য কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে, সেখানে এই পোড়া গ্যাস নিগর্মনের তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব অন্য কোম্পানিগুলোর।
এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান যত তেল উৎপাদন করে তার ৫০ ভাগ, অর্থাৎ মূল উৎপাদনই হয় এধরনের তেল ক্ষেত্রগুলোতে।
এগুলো হলো আধুনিক যুগের বলিদান অঞ্চল, যেখানে মানুষের স্বাস্থ্য, মানবাধিকার এবং পরিবেশকে বলি দেয়া হচ্ছে মুনাফা আর ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে।
কয়েক মাস ধরে গবেষণা চালিয়ে বিবিসি দেখেছে, যেসব তেল ক্ষেত্রে এধরনের গ্যাস নির্গমন সংক্রান্ত তথ্য এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করছে না, সেখানে তাদের হয়ে আর কেউ এই তথ্য জানাচ্ছে না।
উপগ্রহ থেকে বাতাসে গ্যাস পোড়ানোর যে তথ্য বিশ্বব্যাংক সংগ্রহ করে, তা বিশ্লেষণ করে বিবিসি প্রত্যেকটা সাইটে গ্যাসের নির্গমন চিহ্নিত করেছে। বিবিসি বলছে, আমরা হিসাব করেছি যে ২০২১ সালে এধরনের আগুন থেকে প্রায় দুই কোটি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়েছে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
এই নির্গমন বছরে ৪৪ লাখ গাড়ি থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের সমান।
জবাবে এই পাঁচটি তেল প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকেই বলেছে, এসব তেল ক্ষেত্রে নির্গমন সম্পর্কে তথ্য দেয়ার ব্যাপারে তারা বিধিমালা মেনেই কাজ করে। যেখানে তেল স্থাপনা পরিচালনার সরাসরি দায়িত্ব তাদের সেখানে তারা এই তথ্য প্রকাশ করে।
শেল আর এনি আরও বলেছে, যেসব তেল স্থাপনা পরিচালনার দায়িত্ব তাদের নয়, সেসব স্থাপনায় গ্যাস নির্গমনের তথ্য সার্বিক পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কিন্তু তা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয় না। এমনকি বিশ্বব্যাংককে গ্যাস নির্গমন কমানোর যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছিল, সেখানেও এ বিষয়ে আলাদা করে কোন তথ্য দেয়া হয় না।
বিবিসি নিউজ অ্যারাবিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ‘ফ্লেয়ারিং’ বা অব্যবহৃত গ্যাস পোড়ানোর কারণে ইরাকে তেল ক্ষেত্রের কাছে থাকা বাসিন্দাদের কোন কোন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়েছে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেল ক্ষেত্রগুলোর কয়েকটি রয়েছে দক্ষিণ পূর্ব ইরাকের বসরা, রুমাইলা, পশ্চিম কুরনা, জুবায়ের এবং নাহরান ওমার-এ। সেখানকার বাসিন্দাদের দীর্ঘ দিনের সন্দেহ শৈশবকালীন লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যান্সার সেখানে বাড়ছে এবং এর জন্য দায়ী গ্যাস পোড়ানো।
বাসরা এলাকায় ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সব ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা ২০ ভাগ বেড়েছে। বিবিসি নিউজ অ্যারাবিক এই তথ্য পেয়েছে ইরাকের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ফাঁস হওয়া এক রিপোর্ট থেকে। এই রিপোর্টে এর জন্য দায়ী করা হয়েছে বায়ু দূষণকে।
রুমাইলা আর জুবায়েরের তেল ক্ষেত্র দুটির জন্য মূল চুক্তি হয়েছে যথাক্রমে বিপি আর এনির সঙ্গে। কিন্তু যেহেতু বিপি আর এনি এগুলো সরাসরি পরিচালনা করে না, ফলে গ্যাস নির্গমণের কোনো তথ্য তারা প্রকাশ করে না। যারা তেল ক্ষেত্রগুলো চালায় তারাও সেটা করে না।
বিবিসি নিউজ অ্যারাবিক ২০২১ সালে চারটি তেল ক্ষেত্রের কাছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ করেছে। দু’সপ্তাহ ধরে তারা পরীক্ষা করেছে পোড়া গ্যাস থেকে ক্যান্সার হয় এমন পদার্থ নির্গত হচ্ছে কিনা।
অন্তত চারটি জায়গায় বাতাসের নমুনা পরীক্ষায় যে পরিমাণ বেনজিন পাওয়া গেছে তা ইরাকে এই রাসায়নিক নির্গমনের জন্য বেঁধে দেয়া জাতীয় সর্বোচ্চ সীমার সমান বা তার চেয়েও বেশি। বেনজিনের সাথে রক্তের ক্যান্সার লিউকেমিয়া এবং অন্যান্য রক্তের অসুখের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
বিবিসি বলছে, আমরা ৫২জন শিশুর মূত্রের নমুনা পরীক্ষা করেছি। এর মধ্যে ৭০ ভাগ নমুনায় উচ্চ মাত্রার ২-ন্যাপথল পেয়েছি। ন্যাপথালিন নামে যে রাসায়নিক পদার্থ থেকে ক্যান্সার হয় ২-ন্যাপথল তারই একটি ধরন।
আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শৈশবকালীন ক্যান্সার বিষয়ক অধ্যাপক ড. ম্যানুয়েলা অর্জুয়েলা-গ্রিম বলছেন : ‘শিশুদের শরীরে এটা খুব বেশি মাত্রায় আছে… তাদের স্বাস্থ্যের জন্য এটা খুবই উদ্বেগের এবং তাদের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।’
বিশ্বের যেকোনো তেল ক্ষেত্রের তুলনায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস জ্বালানো হয় ২৫ মাইল দূরের রুমাইলা তেল ক্ষেত্রে। বিবিসির হিসাব অনুযায়ী, এখান থেকে যে জ্বালানি উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে এক বছরে ব্রিটেনের প্রায় ৩০ লাখ বাড়িতে বিদ্যুতের যোগান দেয়া সম্ভব।
সেখানে চুক্তি অনুযায়ী মূল মালিকানা বিপির। তাদের অধীনে তেল ক্ষেত্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে রুমাইলা অপারেটিং অর্গানাইজেশন (আরওও)। বিপি তাদের তত্ত্বাবধান করে। কিন্তু বিপি বা ওই পরিচালনা সংস্থা কেউই গ্যাস পোড়ানোর তথ্য জানায় না।
আরওও-র পরিচালনার নিয়মবিধি সই করেছে বিপি। তারা বলছে : ‘দূষণের নির্ধারিত জাতীয় সর্বোচ্চ মাত্রা ছাড়ানোর কারণে কারোর যদি ক্ষতি হয়ে থাকে, তাহলে সে আইনত ক্ষতিপূরণ পেতে পারে।’
তেল ক্ষেত্রগুলোতে যে পরিমাণ অব্যবহৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়, তা যদি একত্রিত করে ব্যবহার করা হতো, সেই গ্যাস রাশিয়া থেকে ইউরোপে আমদানি করা গ্যাসের দশ ভাগের নয় ভাগ চাহিদা পূরণ করতে পারত। এই পরিসংখ্যান দিয়েছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা।
অবশ্য এই গ্যাস কোনো আধারে ধরা, বিশ্ব ব্যাংক বলছে, প্রাথমিকভাবে ব্যয়বহুল এবং কারিগরিভাবে কঠিন। তাদের হিসাব অনুযায়ী, নিয়মিতভাবে যে ‘ফ্লেয়ারিং’ বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্যাস পুড়িয়ে দেয়া হয় তা বন্ধ করতে ১০,০০০ কোটি ডলার খরচ লাগতে পারে।
কিন্তু এই পোড়ানো গ্যাস ধরে রাখার বিষয়ে কোম্পানিগুলো পরামর্শ দেয় ক্যাটেরিও নামে একটি সংস্থা। তার প্রধান নির্বাহী মার্ক ডেভিস বিবিসিকে বলেছেন, নরওয়ের মতো দেশ দেখিয়েছে কড়া নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এটা করা সম্ভব।
নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। প্রতি বছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৬
আপনার মতামত জানানঃ