কিউবা বলতেই কাস্ত্রো, চে; কিউবা বলতেই পশ্চিমাদের মুখে কমিউনিজমের থাপ্পড়। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রে, বাণিজ্য অবরোধেও কাঁধ ঝোঁকেনি হাভানার। ফিদেল কাস্ত্রোকে তার ৯০ বছরের জীবনে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর চরেরা এই চেষ্টা চালায়। হত্যার ষড়যন্ত্র বেশির ভাগই করা হয় তার শাসনামলের শুরুতে। এবার সুযোগসন্ধানী যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
আর সোভিয়েত-পরবর্তী যুগে এর থেকে গভীর সংকটে পড়েনি কিউবা। মার্কিন অবরোধ, ষড়যন্ত্র, উস্কানি, বৈশ্বিক খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী, অভ্যন্তরীণ দমনপীড়ন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মুদ্রাবাজারে কিউবান পেসোর অবমূল্যায়ন, কম মজুরি, ধসে যাওয়া বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় মুষড়ে পড়া হাভানার কাঁধ আরো ঝুঁকে গেছে এই করোনা মহামারিতে। গত বছর দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ১১ শতাংশ হারে। তিন দশকের মধ্যে এটিই দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকোচনের সর্বোচ্চ হার। আর এতেই ভেঙে গেছে কিউবার ক্ষমতার শৃঙ্খল। যার সুযোগ নিতে উঠে পড়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র।
হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোয় পেনিসিলিন বা অ্যাসপিরিনের মতো সাধারণ ওষুধেরও সংকট দেখা দিয়েছে। মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
একদিকে দেশটির জনগণের একাংশ প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডিয়াজ কানেলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে। এক সপ্তাহ জুড়ে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে বিক্ষুব্ধরা। অন্যদিকে রাস্তায় নেমেছে প্রেসিডেন্টের সমর্থকরাও। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারাও।
কিউবার প্রেসিডেন্ট বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করলেও, বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন কৌশলী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমাদের অনেকেই।
সংকটে বিক্ষোভ; বিক্ষোভে দমনপীড়ন
মহামারী ও অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে এখন কিউবার প্রতিটি খাতই ধুঁকছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জন্যও কিউবার স্বাস্থ্য খাত ছিল ঈর্ষণীয়। বর্তমানে এই খাতটিও ধসের মুখে। হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোয় পেনিসিলিন বা অ্যাসপিরিনের মতো সাধারণ ওষুধেরও সংকট দেখা দিয়েছে। মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
অন্যদিকে চূড়ান্ত আকার নিয়েছে খাদ্য সংকট। অর্থহীন হয়ে পড়েছে অনেকেই। যাদের হাতে এখনো কিছু অর্থ রয়েছে, বিন ও চালের জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে একটু পরপর। একবার বিদ্যুৎ গেলে তা আর ফিরে আসছে না সহজে।
দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি বড় উৎস ছিল পর্যটন খাত। কোভিড-১৯-এর কারণে এ খাতে কর্মরতরা এখন পুরোপুরি বেকার। এছাড়া দেশটির অর্থনীতিতে প্রতি বছর ২০০-৩০০ কোটি ডলার যুক্ত হতো রেমিট্যান্স হিসেবে। এর সিংহভাগই আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সে পথও পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। তার সময়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করে ফেলায় কিউবান আমেরিকানরাও এখন আর নিজ দেশে অর্থ পাঠাতে পারছেন না।
অন্যদিকে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগে ট্রাম্পের কিউবা নীতিতে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি হোয়াইট হাউজ।
কিউবার বড় রফতানি পণ্য চিনি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে কিউবায় পণ্যটির বাণিজ্যেও বড় ধরনের ধস নেমেছে। রয়টার্স জানাচ্ছে, দেশটির অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখের উৎপাদনও নেমে এসেছে ১৯০৮ সালের পর সর্বনিম্নে।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কিউবায় জিনিসপত্রের দাম ৫০০% হতে ৯০০% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
কিউবার রাজস্ব খাত যখন ধুঁকছে, তখনই এ সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে বৈশ্বিক খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা ও কিউবান পেসোর অবমূল্যায়ন। খাদ্যপণ্য আমদানিতে দেশটিকে এখন ব্যয় করতে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। সব মিলিয়ে দেশটির অর্থনীতি এখন মারাত্মক এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
কলম্বিয়ার পন্টিফিকিয়া জাভেরিয়ানা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ পাভেল ভিডালের অনুমান, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কিউবায় জিনিসপত্রের দাম ৫০০% হতে ৯০০% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
গত বছর হতে কিউবার সরকার এমন কিছু দোকান খুলেছে যেখানে কিউবার মানুষ বৈদেশিক মুদ্রায় খাবার এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এসব দোকান নিয়ে ক্ষুব্ধ, কারণ তারা বেতন পান তাদের জাতীয় মুদ্রা পেসোতে।
কিউবার এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগী মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। রোববার হাভানায় প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। মঙ্গলবার তা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় নেমে সরকার-বিরোধী স্লোগান দেয় সাধারণ মানুষ।
পুলিশ শান্তিপূর্ণ জনতার উপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। বহু বিক্ষোভকারী আহত। এদিকে, পুলিশ এখনো পর্যন্ত কতজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তা জানা যায়নি। তবে বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, শুধু গত মঙ্গলবারই শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কিউবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তরফে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, গত মঙ্গলবার আরোয়ো নারানজো অঞ্চলে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ৩৬ বছরের তেজেদা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তার মৃত্যু হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, পুলিশ শান্তিপূর্ণ জনতার উপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। বহু বিক্ষোভকারী আহত। এদিকে, পুলিশ এখনো পর্যন্ত কতজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তা জানা যায়নি। তবে বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, শুধু গত মঙ্গলবারই শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরকার সমর্থকরাও রাস্তায় নেমে পড়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। তাদের অভিযোগ, মার্কিন চক্রান্তে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন একদল মানুষ।
এদিকে, গত রবিবার সন্ধ্যায় কিউবার সরকার মোবাইল ফোনের ইন্টারেনট সেবায় বাধা দিতে শুরু করে, ইন্টারনেট সংযোগ কমিয়ে আনতে থাকে।
গত মঙ্গলবার নাগাদ কিউবার অবাধ তথ্য প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা শুরু করে। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের সেবার ওপর আংশিক বিধিনিষেধ জারি হয় এবং কিছু সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে টার্গেট করে সেগুলো ব্লক করা হয়।
একজন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী বিবিসিকে জানান, “ইন্টারনেট সংযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন; আমি জানি না আমার অনেক বন্ধু এখন কোথায় আছে।”
সুযোগসন্ধানী যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদে কিউবার কমিউনিজম
সেই ১৯৫৯ সাল থেকে কিউবায় কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় রয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারার নেতৃত্বে সংগঠিত এক অভ্যুত্থানে একনায়ক ফালগেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর থেকেই প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে কিউবাকে।
দেশটির চলমান সংকট কিউবার গত ৬২ বছরের ইতিহাসে প্রথম নয়। এর মধ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশকিছু বড় সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে দেশটিকে। এমনকি দেশটিকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রমও হয়েছে অতীতে।
দীর্ঘদিন দেশটির ওপর অবরোধ ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ফিদেল কাস্ত্রোর আমলে এসব সংকট থেকে ভালোভাবেই উতরে যেতে পেরেছে দেশটি। ফিদেলের ভাই রাউল কাস্ত্রোর আমলেও কিউবার পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলক স্থিতিশীল।
আর কিউবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবারই প্রথম বড় কোনো সংকটের মুখোমুখি হলেন মিগুয়েল ডিয়াজ কানেল। পর্যবেক্ষকদের মতে, বর্তমান এই পরিস্থিতি উতরে যেতে হলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাস্ত্রো ভাইদের মতোই নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক সক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে তাকে।
তবে মার্কিন অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা কিউবার সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে না পারলেও দেশটির সাধারণ জনগণের জন্য জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিউবার পরিস্থিতি যে বর্তমানে একেবারেই ভালো নয়, তা স্বীকার করছে দেশটির সরকারও।
প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডায়াজ কানেলও বলেছেন, গত কয়েকটি মাস কিউবানদের কীভাবে গিয়েছে, তা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন তিনি। একই সঙ্গে জনগণের প্রতি ধৈর্য ধারণেরও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
আমাদের এখন উসকে দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চায়, কিন্তু কিউবায় তারা কাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসতে চায়? — প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডায়াজ কানেল
পাশাপাশি সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেই গোটা পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন কিউবার প্রেসিডেন্ট। তার ভাষ্যমতে, কিউবা যখন খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কোভিডে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের আবেগকে কাজে লাগানোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
সম্প্রতি তিনি বলেছেন, আমাদের জনগণের সামনে একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেয়া উচিত; বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারে। কিন্তু আমাদের এও স্পষ্টভাবে দেখতে জানতে হবে, আমাদের এখন উসকে দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চায়, কিন্তু কিউবায় তারা কাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসতে চায়?
মিগুয়েল ডিয়াজ কানেলের ভাষ্যমতে, আমরা অতীতে বিভিন্ন গোলযোগ থেকে শিক্ষা নিয়েছি। সমস্যা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করে তার ভিত্তিতে আমাদের বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে এবং ভবিষ্যতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
দশকের পর দশক ধরে কিউবার কর্তৃত্ববাদী সরকারের দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুঃসহ পরিস্থিতিতে গিয়েছে কিউবার জনগণ। আমরা কিউবার জনগণ ও এ পরিস্থিতি থেকে তাদের মুক্তির জোর দাবির প্রতি সংহতি জানাচ্ছি। — প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
সম্প্রতি আরেক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, মার্কিন অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞায় কিউবার সংকট আরো গভীর হয়ে উঠেছে। এ অবরোধের কারণে আমরা আমাদের প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে পারছি না। এটি আমাদের শ্লথ করে দিচ্ছে। উন্নতির পথে আমরা কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে যেতে পারছি না।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এরই মধ্যে কিউবার বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি ঘোষণা করে বক্তব্য রেখেছেন। গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, দশকের পর দশক ধরে কিউবার কর্তৃত্ববাদী সরকারের দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুঃসহ পরিস্থিতিতে গিয়েছে কিউবার জনগণ। আমরা কিউবার জনগণ ও এ পরিস্থিতি থেকে তাদের মুক্তির জোর দাবির প্রতি সংহতি জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯৩৫
আপনার মতামত জানানঃ