তালিবানি শাসন চাওয়া মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার মাওলানা মাহমুদুল তালিবানি শাসন চাওয়া নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা বলে দাবি করেছে র্যাব। এর আগে নোয়াখালী থেকে গত ৫ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
র্যাব বলছে, মাহমুদুল হাসান গুনবী ওয়াজ করে পরিচিতি লাভ করলেও তিনি বর্তমানে আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ‘মানহাজি’ নামের একটি গ্রুপের অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে কাজ করছিলেন। তার সঙ্গে মাওলানা হারুন ইজহার ও আলী হাসান ওসামা নামে আরও দুজন দায়িত্বশীল হিসেবে কাজ করতেন। এই দুজন আগেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
নোয়াখালী থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর গত ৯ জুলাই গুনবীর সন্ধান চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তার পরিবার। নোয়াখালী টিভি সাংবাদিক ফোরাম কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন হয়।
গুনবীর বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুনবতী গ্রামে।
সংবাদ সম্মেলনে তার স্বজনরা জানান, ৫ জুলাই সকালে তিনি নোয়াখালী সদরের করমুল্যা ইউনিয়নের পশ্চিম শুল্লাকিয়া গ্রামে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে সাদাপোশাকে কয়েকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে থানাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে গিয়েও কোনো সন্ধান পাচ্ছিলেন না স্বজনরা।
সদস্যদের ‘মনস্তাত্ত্বিক অনুশোচনা’ জাগ্রত করতেন গুনবি
আজ শুক্রবার (১৬ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন/প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকে ভেতরে ভেতরে উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচার করে জঙ্গি সদস্য তৈরিতে ‘ছায়া সংগঠন’ পরিচালনা করে আসছিলেন মাহমুদ হাসান গুনবী ওরফে হাসান। জঙ্গিবাদ প্রশিক্ষণে গুনবী একজন ‘মানহাজি’ সদস্য ছিলেন।
তার কাজ ছিল মাদরাসাছাত্র ও অন্য ধর্ম থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করা সদস্যদের ‘মনস্তাত্ত্বিক অনুশোচনা’ জাগ্রত করা।
তিনি বলেন, গত ৫ মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি আল সাকিব (২০) ও ওসামার মতাদর্শ পরিবর্তন করে আত্মঘাতী পন্থায় উদ্বুদ্ধ করার পেছনে মাহমুদ হাসান গুনবী ওরফে হাসানের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকায় জড়ো হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করা।
খন্দকার আল মঈন বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য আল সাকিব ও ওসামা গ্রেপ্তারের পর থেকে গত মে মাসের প্রথম দিকে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান গুনবী। তিনি কুমিল্লা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে গিয়ে দুর্গম এলাকায় আত্মগোপন করেন। জুনের শেষের দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে তিনি পুনরায় স্থান পরিবর্তন করে বান্দরবানে অবস্থান নেন। সেখানে ২-৩ দিন অবস্থান করেন। পরবর্তীতে তিনি লক্ষ্মীপুরের চর গজারিয়া ও চর রমিজে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে বেশ কয়েকদিন পার করে দেন। এরপর তিনি আবারও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা টের পেয়ে যান এবং স্থানও পরিবর্তন করেন। অতঃপর তিনি উত্তরবঙ্গে আত্মগোপন করেন। সেখান থেকে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।
জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিতেন গুনবী
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, আল-কায়েদা মতাদর্শী একটি জঙ্গিগোষ্ঠী দাওয়াতুল ইসলাম নামের একটি সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতি কাজ চালাচ্ছে। দাওয়াতুল ইসলাম নামের সংগঠনের আড়ালে পার্বত্য এলাকায় এই উগ্রবাদী কার্যক্রমের নেতৃত্বে আছেন মাহমুদুল হাসান গুনবী। তিনি বান্দরবানের লামা ও খাগড়াছড়িতে দুটি জঙ্গি আস্তানাও গড়ে তুলেছেন। সেখানে এই গোষ্ঠী ২০ থেকে ২৫ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
জঙ্গি কার্যক্রমে গোয়েন্দা নজরদারিতে যুক্ত একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, উগ্রবাদী ওয়াজের জন্য পরিচিত মাহমুদুল হাসান গুনবী বর্তমানে আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা। তবে তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, দাওয়াতুল ইসলাম নামের একটি সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই সংগঠনের কার্যক্রমের নামে পার্বত্য অঞ্চলে এবং উত্তরবঙ্গে চরাঞ্চলের কিছু এলাকায় আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম ও উগ্র মতাদর্শ প্রচার করে আসছেন। আনসার আল ইসলাম নিজেদের আল–কায়েদার ভারত উপমহাদেশের (একিউআইএস) শাখা দাবি করে থাকে।
সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজের মাধ্যমে উগ্রবাদ ছড়ানোর পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে পরিচিতি পান মাহমুদুল হাসান গুনবী। ধর্মীয় প্রচারণার আড়ালে কৌশলে কথিত জিহাদ ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদের দলে বেড়ানোর উদ্দেশ্য লক্ষণীয়। ইসলামি এই বক্তা ওয়াজের নামে কথিত জিহাদের ডাক দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করে আসছেন।
ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে কোমলমতি কিশোর-তরুণদের ব্রেনওয়াশের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিতেন। ইউটিউবে ওয়াজের নামে উগ্রবাদ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতেন। তাদের ভুল ব্যাখ্যায় মোটিভেটেড হয়ে অনেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। তারই ওয়াজ নসিহতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্প্রতি সাকিব নামের এক তরুণ তলোয়ার নিয়ে সংসদ ভবন আক্রমণ করতে গেলে র্যাবের হাতে আটক হন।
সম্প্রতি আনসার আল ইসলামের কয়েক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে এপ্রিলে আনসার আল ইসলামের আইটি বিভাগের প্রধানসহ দুই সদস্য আরিফুল ইসলাম জাহেদ ওরফে আইমান ওরফে আরাহান ওরফে রেহান (৩০) এবং বাকী বিল্লাহ ওরফে আবু সামির ওরফে জাফর ওরফে ফয়সালকে (৩৪) গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ (সিটিটিসি)। রাজধানীর পল্টন থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়া গত মে মাসে খুলনা থেকে আনসার আল ইসলামের চার সদস্যকে আটক করা হয়। তারা হলেন খুলনার তেরখাদা দক্ষিণ পাড়া এলাকার মো. আবির মাহমুদ (২৮), ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মো. আবু বকর সিকদার (২০), দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী (২১) ও নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার আশরাফুল ইসলাম ওরফে আবু আবদুল্লাহ (৩১)।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৩
আপনার মতামত জানানঃ