দুর্নীতি আর অনিয়মের অন্য নাম বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যেখানে তারা সফলভাবে অনিয়ম দুর্নীতি করেনি। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য সামনে এসেছে। বীজ কিংবা সার চুরি, বেতন-ভাতা আত্মসাত, অপ্রয়োজনে যন্ত্রপাতি ক্রয়, শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে অস্বচ্ছতা- এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বহর দেখলে দেশের নাজুক কৃষিব্যবস্থার কারণ বুঝতে কাউকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে না। এর কোন প্রতিকার নেই। কর্মকর্তারা পুরুষানুক্রমে এই দুর্নীতির চাকা সচল রাখছেন।
চার কোটি টাকার বেতন-ভাতা আত্মসাত
ভুয়া শ্রমিক দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিএডিসি’র বিরুদ্ধে। কৃষি ফার্ম শ্রমিক নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা অমান্য করে প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬-২০১৭ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় চার কোটি টাকার গরমিল করেছে।
বাধ্যবাধকতা থাকলেও নিয়োগের সময় শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য তথ্য গ্রহণ করা হয়নি। সূত্র মতে, কেবলমাত্র একটি বিলে স্বাক্ষর গ্রহণ করেই প্রায় এক কোটি ৩১ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে। এখানে অর্থগ্রহণকারীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি বা অন্য কোনও তথ্য ছিল না।
একইভাবে জেলার বীজ উৎপাদন খামারেও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ‘শ্রমিক নিয়োগ’ দেয়া হয়। এতেও বিলে স্বাক্ষর নিয়ে প্রায় ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে। পাওয়া যায়নি কারও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি
যেখানে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ৬ জুলাই জারি করা কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা-১ অধিশাখার পরিপত্র ‘কৃষি ফার্ম শ্রমিক নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ২০১৭’ অনুযায়ী অনিয়মিত শ্রমিক (অস্থায়ী/সাময়িক/মৌসুমি) নিয়োগের অন্যতম শর্ত হলো জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে এবং বার্ষিক কর্মবণ্টন তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন নিতে হবে।
খরচের চেয়ে সাড়ে ছয় লাখ টাকা বেশি বিল
ফোর্সমোড নলকূপ স্কিমে ইউপিভিসি পাইপ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণে প্রকৃত খরচের চেয়েও সাড়ে ছয় লাখ টাকা বেশি পরিশোধ হয়েছে। প্রকল্পের পানি নিয়ন্ত্রণ বা সংরক্ষণ অবকাঠামো নির্মাণেও প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি কাজ দেখিয়ে ঠিকাদারদের প্রায় ১২ লাখ ৪৪ হাজার এবং বিভিন্ন পূর্তকাজের বিপরীতে দুই লাখ টাকারও বেশি অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিলেটের শেখঘাট বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট আওতাভুক্ত সিলেট ও হবিগঞ্জ অঞ্চলের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ দশমিক ৫/২ কিউসেক ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণ করা হয়। নথি, বিল-ভাউচার, ব্যয় বিবরণী ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ প্রকল্পে প্রকৃত খরচের চেয়ে বার্ষিক হিসাব বিবরণীতে সাড়ে ৬ লাখ টাকারও বেশি দেখানো হয়েছে।
প্রকল্পের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব কোড ৪১১৩০৬ খাতে সেচনালা নির্মাণে ২০১৯ সালের ৩০ জুন ১৭৪, ১৫৮, ১৮০ নং বিলের মাধ্যমে ৩২ লাখ ২৪ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। একই বছরের ১৭ এপ্রিল ৬৫ নং বিলের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এবং ১০৬ নং বিলের মাধ্যমে ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।
সব মিলিয়ে খরচ হয় ৫৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা। অথচ, হিসাব বিবরণীতে দেখানো হয় ৬০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
প্রয়োজন ৭৮ হাজার, কিনলো সাড়ে ১০ লাখ!
বিএডিসি নিয়ন্ত্রণাধীন নরসিংদীর ডাল ও তৈল বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে মাত্র ৭৮ হাজার ৫০৮টি প্যাকেটের জন্য সমপরিমাণ লিফলেটের প্রয়োজন হলেও কেনা হয়েছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৫টি। কার্যালয়টির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষায় ধরা পড়ে এ অনিয়ম।
সূত্র মতে, প্রক্রিয়াজাত করা বীজের চালানপত্র, বিল-ভাউচার, ক্যাশ বই, ব্যাংক বিবরণী নিরীক্ষা করে অতিরিক্ত লিফলেট ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নিরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি প্যাকেটে ১ কেজি ধরে ৭৮ হাজার ৫০৮ কেজি সরিষা বীজ প্রক্রিয়াজাত করতে সমপরিমাণ প্যাকেটের দরকার। প্রতিটি প্যাকেটে ১টি করে লিফলেট লাগানো হলেও সমপরিমাণ লিফলেটের প্রয়োজন।
কিন্তু দুটি বিলের মাধ্যমে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৫টি লিফলেট কেনা হয়। প্রতিটি লিফলেটের দাম ৬০ পয়সা করে অতিরিক্ত ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৪১৪টি লিফলেট কেনা হয়েছে।
প্রয়োজন ছাড়াই ৫০ লাখ টাকার যন্ত্র
প্রয়োজন ছাড়াই প্রায় অর্ধকোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। জানা গেছে, বিএডিসি’র আওতাধীন হবিগঞ্জের ইটাখোলা প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র, ঝিনাইদহের দত্তনগর বীজ উৎপাদন খামার ও একই জেলার করিঞ্চা বীজ উৎপাদন খামারের ২০১৬-১৭ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হিসাব নিরীক্ষায় দেখা যায়, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বিএডিসি’র প্রধান কার্যালয় হতে সিড ড্রায়ার মেশিন কেনা হয়েছে।
ইটাখোলা বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রটির অফিসে বিএডিসির প্রধান কার্যালয় থেকে ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর নতুন সিড ড্রায়ার মেশিন সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ওই অফিসে এ যন্ত্র আগেই চারটি ছিল। নতুন ড্রায়ারটির দাম ১৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা। লগবইতে দেখা যায় মেশিনটি ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ব্যবহারই করা হয়নি।
২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি হতে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ঝিনেইদহের দত্তনগর বীজ উৎপাদন খামারের রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায়, চাষাবাদের জন্য খুবই ছোট আকারের প্ল্যান্টার মেশিন খামারে পাঠানো হয়। যার দাম ১৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এই মেশিন দিয়ে ৫০০ একরের খামারটির পাঁচ একরও চাষাবাদ করা যাবে না। এ ছাড়া মেশিনটি চালানোর মতো টেকনিশিয়ানও নেই সেখানে।
স্বাক্ষর ছাড়াই ১১ লাখ টাকার জ্বালানি!
ইটাখোলা বীজ উৎপাদন খামারে ২০১৬-২০১৭ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত বিভিন্ন বিলের মাধ্যমে প্রায় ১১ লাখ টাকার জ্বালানি তেল কেনা হয়েছে।
খামার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব জ্বালানি খামারটির উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার টিলার, টাফি, সোনালিকা ও বেলারুশ ট্রাক্টরে ব্যবহার করা হয়েছে।
অথচ অফিস সহকারী লগবইতে তেলের বরাদ্দ লিপিবদ্ধ থাকলেও সেখানে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ড্রাইভার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও স্বাক্ষর নেই।
জ্বালানি মজুদ রেজিস্ট্রারও হালনাগাদ করা নেই। আদৌ এ জ্বালানি ব্যবহার হয়েছে কি-না তা নিয়ে প্রতিবেদনে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে।
গুদামে বিপুল পরিমাণ সারের ঘাটতি
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-এর সিলেট গুদাম থেকে উধাও হয়েছে মজুত রাখা সার। ৪ দশমিক ৬৫ মেট্রিক টন টিএসপি ও এক দশমিক ৫ মেট্রিক টন ডিএপি সারের হসিদ মিলছে না।
তদন্তকারীদের অনুসন্ধানে সিলেট বিএডিসির কদমতলী অফিসের যুগ্মপরিচালকের (সার) ২০১৬-১৯ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা করা হয়। এতে ৪ দশমিক ৬৫ মেট্রিক টন টিএসপি এবং ১ দশমিক ৫ মেট্রিক টন ডিএপি সারের ঘাটতি ধরা পড়ে। যার মূল্য প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি হতে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এই তদন্ত পরিচালিত হয়।
তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র সারের গরমিল ধরা পড়ে। কেন্দ্রগুলো হচ্ছে সিলেট, শায়েস্তাগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। সিলেট সার গুদামে ১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন টিএসপি, শায়েস্তাগঞ্জ গুদামে দশমিক ৫ মেট্রেক টন ডিএপি ও সুনামগঞ্জ গুদামে দশমিক ৭৫০ মে. টন টিএসপি, লাউয়াই সার গুদামে ২ মেট্রিক টন টিএসপি এবং সিলেট প্রি-ফেব্রিকেটেড সার গুদামে ০ দশমিক ৫৫০ মেট্রেক টন ডিএপি সারের ঘাটতি পাওয়া যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ