নিয়মের কোনো বালাই নেই দেশের কারখানাগুলোতে। আগুনের ঝুঁকি কমাতে যে যে নিয়মগুলো মানা দরকার তার সিকিভাগও মানছে না। নিজেদের ব্যয় সংকোচন করতে গিয়ে কিংবা গাফিলতিতে কারখানাগুলো মৃত্যুকুপে পরিণত হয়েছে।
দেশের প্রতিটি কারখানায় বৈদ্যুতিক সুরক্ষার গড় ঘাটতি ৫০ শতাংশ। আর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কারখানায় কাঠামোগত ঝুঁকি রয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকির ক্ষেত্রে এ ‘উদ্বেগজনক চিত্র’ উঠে এসেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) একটি জরিপে। দেশের মোট ৩০০টি কারখানা পরিদর্শন করে এই জরিপ করা হয়।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, আগুনের ঝুঁকি কমাতে যে বিষয়গুলো মেনে চলা দরকার, একেকটি কারখানা গড়ে তার ৬০ শতাংশই পূরণ করছে না।
কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর জানায়, তাদের ‘চেকলিস্টে’ কারখানায় আগুন লাগার ৬৭ ধরনের ঝুঁকি নির্দেশক রয়েছে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে ৭৪টি, কাঠামোগত ক্ষেত্রে ৭টি ও অন্যান্য বিষয়ে ১৮টি ঝুঁকি নির্দেশক রয়েছে। চেকলিস্টটি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানগুলোর ভিত্তিতে।
নির্বাচিত তৈরি পোশাক কারখানা, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানার প্রাথমিক ঝুঁকি নিরূপণ নামের একটি প্রকল্পের অধীনে জরিপটি করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে মোট ১ হাজার ১০১টি কারখানার ঝুঁকি নিরূপণ করার কথা। এগুলোর মধ্যে ৩০০টি কারখানা পরিদর্শন শেষে প্রাথমিকভাবে নিয়ম না মানার এই প্রবণতা পাওয়া গেছে।
অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, রাসায়নিক, খাদ্যপ্রক্রিয়াজাতসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ৬১ হাজার ৭৬৯টি কারখানা রয়েছে।
আগুনের ঝুঁকি কমাতে যে বিষয়গুলো মেনে চলা দরকার, একেকটি কারখানা গড়ে তার ৬০ শতাংশই পূরণ করছে না।
কর্মকর্তারা বলছেন, একটি কারখানার একটি তলায় আগুন লাগলে সেটা যাতে পুরো ভবনে ছড়িয়ে না পড়ে, সেটা নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকতে হয়। কারখানা ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্র বা রাসায়নিক থাকলে তাতে আগুন লেগে শ্রমিকদের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই ওই জায়গাগুলো অগ্নি প্রতিরোধক ব্যবস্থার মাধ্যমে আলাদা করে ফেলতে হয়। এমন আরও অনেক নিয়মকানুন দেশের প্রচলিত আইনেই রয়েছে।
পরিদর্শনে কারখানায় নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানান কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের এই প্রকল্পের পরিচালক ও অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) সৈয়দ আবুল এহসান এবং অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (সেফটি) আব্দুল মুমিন।
আব্দুল মুমিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কারখানায় আগুন লাগলে ফায়ার অ্যালার্ম (অগ্নিসংকেত ব্যবস্থা) বেজে ওঠার কথা। অনেক কারখানায় এটা থাকে না। আগুন লাগার পর তা নেভাতে কারখানায় বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা থাকতে হয়; তা–ও থাকে না। শ্রমিকদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
হাশেম ফুডসে গত বৃহস্পতিবার আগুনের ঘটনায় ৫২ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে একটি কক্ষেই ৪৯ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হাশেম ফুডসের কারখানার ছয়তলা একটি ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ছয়টি তলায় তা ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটি পরিদর্শন করে বলেছেন, সেখানে ফায়ার অ্যালার্মের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্মোক ডিটেক্টরও (ধোঁয়া শনাক্তের ব্যবস্থা) পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া শ্রমিকদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি বহির্গমন পথ ছিল না।
রূপগঞ্জে আরও ৩০ কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ
বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় ও নতুন-পুরোনো বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা রয়েছে ৩ হাজার ৪৫০টি। এর মধ্যে ৯৯৬টি কারখানাই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জে, যেখানে বৃহস্পতিবার হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় আগুন লেগে ৫২ জনের মৃত্যু হয়।
উপজেলার বরপা, তারাব, ভুলতা, গোলাকান্দাইলসহ আশপাশে রয়েছে এসব কারখানা। এগুলোর ৩০টি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার তালিকায় রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ও বড় প্রতিষ্ঠানও। শ্রমিকের নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা মানদণ্ড অনুসরণ হওয়ার কথা, এসব কারখানার অনেকগুলোতেই রয়েছে তার বড় ধরনের ঘাটতি।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এটি জানিয়েছে।
অধিদপ্তর বলছে, কারখানার মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সংস্কারমূলক ব্যবস্থা বা উন্নয়নমূলক ত্বরিত পদক্ষেপ না নিলে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে সেজান জুস কারখানার মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (রূপগঞ্জ) তানহারুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, অন্তত ৩০টি কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ। শুকনা খাবার তৈরির কারখানার পাশাপাশি স্টিল মিল ও পোশাক এবং টেক্সটাইল মিলও রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার তালিকায়।
কারখানার মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সংস্কারমূলক ব্যবস্থা বা উন্নয়নমূলক ত্বরিত পদক্ষেপ না নিলে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে সেজান জুস কারখানার মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
তানহারুল ইসলাম জানান, এলাকার অনেক কারখানাতেই নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে নেই ইমারজেন্সি এক্সিট ডোরও। কোথাও একটি আবার কোথাও একাধিক সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকদের বাইরে বের হওয়ার একাধিক ব্যবস্থা নেই। যেগুলোতে আছে, সেগুলো প্রায়ই থাকে তালাবদ্ধ, যা শ্রমিকরা ব্যবহার করতে পারে না।
ঝুঁকি এড়াতে ফায়ার সার্ভিস কী পদক্ষেপ নিয়েছে, জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যেসব কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কম ও ইমারজেন্সি এক্সিট ডোর নেই, আমরা তাদের নোটিশ করে থাকি। কেউ নোটিশ না মানলে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়।’
পোশাকশিল্পের বাইরের কারখানায় মৃত্যু বাড়ছে
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, রাসায়নিক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ৬১ হাজার ৭৬৯টি কারখানা রয়েছে।
শ্রম অধিকারবিষয়ক সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে সব ধরনের কারখানায় মোট ১৪টি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে মোট মৃত্যু হয় ১ হাজার ৫৫৩ জনের। এ ছাড়া শুধু রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন পোশাকশ্রমিক মারা যান। এর বাইরে বাকি ১৩টি কারখানায় ৪১৭ জন শ্রমিক অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ওই সময়ে ঘটা অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে মাত্র দুটি ছিল প্যাকেজিং কারখানায়। ২০১৫ সালে মিরপুরের স্টাইরোফোম প্যাকেজ ফ্যাক্টরিতে ১৩ জন, ২০১৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস ফ্যাক্টরিতে ৩৪ জন মারা যান। অগ্নিকাণ্ডের শিকার হওয়া ওই দুই কারখানায় তৈরি পোশাক খাতসহ অন্যান্য শিল্পপণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় মোড়ক এবং প্যাকেট তৈরি হতো। তৈরি পোশাক কারখানার মতো সেখানেও বিভিন্ন তলায় অনেক শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করতেন।
অন্যদিকে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত শিল্পকারখানার অগ্নিকাণ্ডে ১৬৮ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এর মধ্যে ১ জন হচ্ছেন তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই সময়ে এ খাতের ৪০ জন শ্রমিক আহত হন। আর অন্যান্য খাতের শ্রমিকের মৃত্যু সংখ্যা ১৬৭ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ৩০০ শ্রমিক। অর্থাৎ এই সময়ের প্রতি ছয় মাসে ২৪ জন করে শ্রমিক মারা গেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
কারখানায় নিয়ম না মানার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো শুধু সনদ দিয়ে দেয়। তারা শক্তভাবে নজরদারি করে না। নিয়মিত পরিদর্শনও করে না। এ কারণে নিরাপত্তার অভাব রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। অন্য কারখানায় তা হয়নি। কারণ, অন্য কারখানাগুলোর জন্য সরকার ওইভাবে চাপ অনুভব করেনি বা চাপ দেয়নি।
পোশাকশিল্পের বাইরের কারখানায় মৃত্যু বেশি কেন, জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে অর্থনীতি ও শিল্প খাতের উন্নয়নের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসব খাতের তদারককারী সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ছে না। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক খাতের সুরক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে এর বড় কারণ ছিল পণ্য ক্রয় ও কার্যাদেশ প্রদানকারী কোম্পানিগুলো এ জন্য চাপ সৃষ্টি করা। সরকারও এ ব্যাপারে বেশ সোচ্চার ছিল। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারী অন্য শিল্পকারখানাগুলোর সুরক্ষাব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। রূপগঞ্জের হাসেম ফুডে আগুন এর বড় প্রমাণ। এ ধরনের ঘটনা দেশের শ্রম নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকেও নিরুৎসাহিত করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ